রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো নন-পারফর্মিং লোনস (এনপিএল) বা খেলাপি ঋণ, কম মুনাফা, বড় ধরনের পুঁজি ঘাটতি এবং ব্যালেন্স শিট দুর্বলতায় ভুগছে। এ সমস্যার মূলে রয়েছে দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা।
দশকের পর দশক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড় ও দাপুটে ঋণগ্রহীতাদের কাছে মোটা অঙ্কের ঋণ দিয়ে আসছে। তারা অর্থ পরিশোধে গাফিলতির জন্য পরিচিত। ঋণখেলাপিদের শাস্তি দেয়ার নজির বিরল। এর পরিবর্তে একই ঋণগ্রহীতাদের ফের ঋণ প্রদানের অনুমোদন দিতে ঋণ পুনর্বিন্যাস করা হয় নিয়মিত। ঋণখেলাপিদের শাস্তি দেয়া, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা জোরদার করার জন্য তেমন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে আরও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ দুর্বলতার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোসহ পুরো ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইএমএফের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় নতুন করে মূলধন জোগান দিতে গত অর্থবছরের শেষ মাসে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এর মাধ্যমে দেশটির ব্যাংকিং খাত যে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন কঠিন ঝুঁকি মোকাবেলা করছে, তার লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা অপর্যাপ্ত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলছে, অতিরিক্ত তারল্যের কারণে ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতে পরিস্থিতির উন্নয়ন নির্ভর করবে সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। এসব দুর্বলতার পেছনে বহুলাংশে দায়ী বড় অংকের ঋণগ্রহীতাদের দেয়া ঋণ, যাদের অর্থ পরিশোধের তাগিদ কম। পাশাপাশি রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, যা অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে রয়েছে মোট ব্যাংকিং খাতের সম্পদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তাদের সঙ্গে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি বিশেষায়িত উন্নয়ন ব্যাংক, ৪০টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০-১৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো প্রতিবছর গড়ে নয়ছয় হওয়া ঋণ (ব্যাড লোনস) পুনর্বিন্যাস করেছে ১০ হাজার ৯১০ কোটি টাকার। এসব কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে মারাত্মকহারে।
এ পরিস্থিতিতেও সরকার অব্যাহতভাবে অর্থায়ন করে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। অর্থায়ন করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছে। অনেকে বিষয়টি এভাবে দেখছেন যে, সামাজিক খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার পরিবর্তে করদাতাদের অর্থ সেখানে দিচ্ছে সরকার। অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ২০১৭ সালের মার্চে এক বৈঠকে সরকারের অর্থ বিভাগ জানায়, বাজেট তহবিল থেকে নিয়মিত অর্থায়ন সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি। এদিকে গত দু’বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকে পুঁজির জোগান দেয়ার সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ে করেনি।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নিজেদের উদ্যোগে যেমন, ব্যবসায়ী কর্মকাণ্ড জোরদার করে পুঁজি ঘাটতি মেটানোর নির্দেশ দেয়। তা সত্ত্বেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ফের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অর্থায়নের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পুঁজি ঘাটতির বিপরীতে এ বরাদ্দ রাখা হয়। সবচেয়ে বড় অঙ্ক যাচ্ছে বেসিক ব্যাংকে (১ হাজার কোটি টাকা)।
ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় উন্নতি প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সামান্যই। প্রয়োজন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা। বড় ঋণগ্রহীতাদের রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াও নিয়ন্ত্রকরা উদ্বিগ্ন যে, বেশি কঠোর পদক্ষেপ কর্পোরেট দেউলিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
ব্যাংকিং খাতের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতির সমস্যা, ঝুঁকির দুর্বলচর্চা এবং শিল্পের সঙ্গে যোগসাজশের সমস্যা মোকাবেলায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আইএমএফ এমনটাই তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। অর্থায়ন করার পরোক্ষ সরকারি নিশ্চয়তা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় অধিকমাত্রায় তারল্য সৃষ্টি করছে। কিন্তু তাদের হিসাব-নিকাশে আরও অবনতি ঘটলে তা আর্থিক ভারসাম্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্মত হওয়া অঙ্কের টার্গেটের প্রতি কঠোরভাবে জবাবদিহির আওতায় রাখতে হবে ব্যাংকগুলোকে। আর সংস্কারের মনোযোগ দিতে হবে তত্ত্বাবধানের উন্নয়ন, লোন কনসানট্রেশনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ঋণ উদ্ধারের জন্য আইনি ও আর্থিক অবকাঠামোর উন্নয়নের দিকে। তবে শেষ কথা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সমস্যার সমাধান শুরু হতে হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে, কিন্তু এখন পর্যন্ত যা খুব সীমিতই দেখা যাচ্ছে।