সুইস ব্যাংকে যেসব বাংলাদেশি অর্থ জমা রেখেছেন, বাংলাদেশ সরকার কি চাইলে তাদের পরিচয় জানতে পারবেন?
খুব সোজা উত্তর হচ্ছে, না। কারণ সুইজারল্যান্ডের সংবিধান এবং ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী সেখানে ব্যাংক গ্রাহকদের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়।
সুইস ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, গোপনীয়তার অধিকার সুইস আইন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ফেডারেল সংবিধান দ্বারা তা সুরক্ষিত। তবে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে এই সুরক্ষা কাজ করবে না। অর্থাৎ সেখানে গচ্ছিত অর্থ যদি কোন অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশে কোনো বাধা নেই।
ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য, সেই অপরাধ সুইজারল্যান্ডেই হোক আর অন্য কোনো দেশেই হোক।
বাংলাদেশিদের পাঁচ হাজার কোটি টাকা
সুইটজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেদেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ সরকার থেকে অর্থপাচার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না থাকার ফলেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুইস ব্যাংকগুলোতে সারাবিশ্ব থেকেই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ রাখা হয় বলে দুর্নাম রয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে কোনো বিদেশি এসে কিন্তু চাইলেই টাকা রাখতে পারবেন না, অনেক কাগজ লাগবে। কিন্তু অনেক তথাকথিত উন্নত দেশে বাইরের লোকজন টাকা এনে রাখতে পারেন এবং টাকা বৈধ কি অবৈধ সেটি প্রাইভেসির নামে প্রকাশ করা হয় না। ফলে অনেক অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ সেখানে লগ্নি করা হয় বা পাচার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয়। তবে এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের সংস্থাগুলো যথেষ্ট সজাগ রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসীরা যারা বিদেশে কাজ করেন তাদের অনেকেও সেখানে আয় করে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখছেন। সব অর্থই যে দেশ থেকে গেছে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।
তবে অর্থ যে শুধু সুইস ব্যাংকে পাচার হচ্ছে তা নয়। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, বাংলাদেশ থেকে এশিয়া এবং ইউরোপের আরো অনেক দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। এবং এনিয়ে সরকারও কোন কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
দীর্ঘদিন যাবৎ সুইস ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে সেটিরও কোন তথ্য ছিল না। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী, সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক বছর যাবত সেদেশে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করছে।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল কোন দেশের নাগরিকরা সেদেশের ব্যাংকে কি পরিমাণ অর্থ রেখেছেন সেই তথ্যই প্রকাশ করেছে।
কী করতে পারে বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী সুইস ব্যাংকগুলো পরিচিত গ্রাহকদের ব্যাপারে তাদের কঠোর গোপনীয়তার জন্য। আর ঠিক এ কারণেই সারা দুনিয়ার বিত্তশালী আর খ্যাতিমানরা সুইস ব্যাংকে তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখেন।
কাজেই যেসব বাংলাদেশিরা সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছেন, তাদের নাম-পরিচয় জানার কোন উপায় কি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের আছে? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুইস, মালয়েশিয়ান বা সিঙ্গাপুর যেকোন ব্যাংকেরই এখন বাধ্যবাধকতা রয়েছে তথ্য দেয়ার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যদি একসাথে সেসব দেশের কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করে তাহলে শুধু এই অর্থের বৈধতা যেমন জানা সম্ভব, তেমনি এগুলো ফিরিয়েও আনা সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমানের অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা। তবে এর পরে দেশের বাইরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা কাদের সেটি খুঁজে বের করা অথবা সেটি ফিরিয়ে আনার তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, অর্থপাচার দমনে যথেষ্ট পদক্ষেপ না থাকায় একদিকে যেমন অপরাধীরা সুরক্ষা পাচ্ছে, অন্যদিকে পাচারও বাড়ছে।