এক বছর পেরিয়ে গেল গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনার। ওই হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকার করা ওই হামলার এক বছর পার হলেও এখনো ওই মামলার চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এছাড়াও কূটনৈতিক এলাকায় ভয়াবহ ওই জঙ্গি হামলায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি নাগরিক হতাহত হলেও এখনও ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিক ও বিদেশিদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে।
হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিদের অব্যাহত হুমকি দমনের ক্ষেত্রে ঢাকা কম গুরুত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সেইগফ্রেড ও. উলফ।
ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের গবেষণা পরিচালক এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উলফ ‘ডয়েচে ভেলে’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকার প্রতি এ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন।
উলফ বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার দেশটিতে আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু এর দৃশ্যমান উপস্থিতি না থাকলেও আইএসের আদর্শ ধর্মীয় উগ্রবাদী, মৌলবাদী ও সহিংসতাকারীর কাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। আইএস এখনও বাংলাদেশে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি বলেও মনে করেন তিনি।
হলি আর্টিসান হামলার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিষয়ে উলফ বলেন, এটা বড় প্রভাব ফেলবে। কেননা বাংলাদেশে ইসলামপন্থী চরমপস্থা বা সন্ত্রাসবাদের উত্থানকে অবহেলা করছে বৃহৎ শক্তি। এ হামলায় ঢাকা ও পশ্চিমা বিশ্বের জেগে ওঠা উচিত ছিল। যদিও পশ্চিমারা উদ্বেগ জানিয়েছে। কিন্তু প্রধানত বিশ্ব মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল ইস্যুটি নিয়ে সরব হওয়া ও সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের মূল্যায়ন প্রশ্নে তিনি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল শুধু দেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর ফোকাস করছে। এটা বতর্মানে, বিশেষ করে সাময়িকভাবে সফল হয়েছে। এটা বিভিন্ন জঙ্গি ও উগ্রপন্থী গ্রুপের কার্যক্রম হ্রাসে কাজ করছে। কিন্তু সার্বিক হিসাবে ধর্মীয় চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদের পিছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলি অনুপস্থিত।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রী একটি জটিল পরিস্থিতিতে কাজ করছেন, তবে তা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গত কয়েক মাসে প্রগতিশীল, লেখক ও ব্লগারদের ওপর হামলা কমেছে; এতে কী সরকারের কৃতিত্ব রয়েছে- এমন প্রশ্নে উলফ বলেন, আগে লিবারেলরা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারতেন। দেশের গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ প্রগতিশীল ছিল, তারা চরমপন্থার বিরোধীতাও করেছেন। কিন্তু এখন তেমন পরিস্থিতি নেই। ইসলামপন্থীরা আরও উচ্চকণ্ঠ হয়েছে, তারা ধীরে ধীরে জনমতের ওপর কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে।
আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখার বাংলাদেশে শক্তিমত্তা বিষয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকেরই আল কায়েদা ও তালেবানের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে। তাদের অধিকাংশ ছিল ৮০ দশকে সোভিয়েত ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের জঙ্গিরা আল কায়েদার চেয়ে আইএসের প্রতি বেশি অনুরক্ত। ফলে আইএস আরও বেশি সক্রিয় হলেও, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্ষেত্রে আল কায়েদার প্রভাবকে অবমূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই।
কিভাবে আঞ্চলিক ইসলামবাদের গতিবিধি বাংলাদেশে চরমপন্থা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে- এ প্রশ্নের জবাবে উলফ বলেন, আঞ্চলিক নানা কারণে এ চরমপন্থার উদ্ভব ঘটছে। যেমন-মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে এদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকের মধ্য মৌলবাদ জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশি ইসলামপন্থীরা এ অবস্থাকে তাদের সুবিধা অর্জনে ব্যবহার করছে।
এছাড়াও তারা ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে তাদের জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রচারে ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে যুক্তি তুলে ধরছে। তাছাড়া পাকিস্তানকে ইসলামীকরণ ও দুই দেশের মূল ইসলামী দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্কও বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ উসকে দিচ্ছে বলেও মত তার।
এর বাইরেও ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে কার্যক্রম চালানো সীমান্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে অপরিহার্য এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলেও মত দেন উলফ।