ঈদ, আনন্দ কোনোটাই নেই এসিডদগ্ধ নফিছা বেগমের (২৮) কপালে। মানুষের চরম অবহেলা, অসহায়ত্ব আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় আত্মহত্যার পথও খুঁজেছেন নফিছা। তবে একমাত্র সন্তানের দিকে তাকিয়েই আজ তার বেঁচে থাকা।
দুই বেলা দু`মোঠো ভাত ভাগ্যে না জুটলেও স্বপ্ন বোনেন ছেলেকে মানুষ করার। তাইতো ভোর হলেই ছুঁটে চলেন পাথরভাঙা কিংবা অন্য কাজের সন্ধানে। কালে ভদ্রে কাজ পেলেও ঝলসে যাওয়া মুখটা দেখেই শ্রমজীবী অন্যরা কাজ না করার বায়না ধরেন। মালিকপক্ষও লসের ঘানি না টানতে বিতাড়িত করেন নফিছা বেগমকে। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে তাকে। এভাবেই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন এই জয়ীতা।
নফিছা বেগমকে দেখলে নাকি চলার পথ অশুভ হয়ে যায় প্রতিবেশীদের। গর্ভবর্তী মায়েদের তো আরও নানান বাহানা। তাই বাবার ভাঙাভিটার ভাঙা চালায় অনেকটা রুদ্ধদ্বার হয়ে ৩য় শ্রেণি পড়ুয়া সন্তানকে বুকে আগলে দিন যায় তার।
অসহায় এই মানুষটির বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের কামালপুর গ্রামে। ওই গ্রামের দিনমজুর আব্দুল অজুদের মেয়ে তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ২০০৫ সালের প্রথম দিকে গ্রামের হায়েনাদের হাতে এসিডদগ্ধ হন এই নারী। রাতের আঁধারে ছোড়া এসিডে ঝলসে যায় নফিছা বেগমের ডান চোখ, গলা, বুকসহ পেটের কিছু অংশ। সেদিন থেকেই একচোখে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখেন, আর এক চোখেই কাঁদেন।
আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছেন অনেকেই। পাশের বাড়ির অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন দগ্ধ নফিছার সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসার অযুহাতে জেল থেকে বের হন। চলমান মামলাও হয়ে যায় লাগামছাড়া। ভালোই চলছিল নফিছার দাম্পত্য জীবন।
কিন্তু কপালে বেশিদিন সুখ সইল না নফিছা বেগমের। বিয়ের তিন মাসের মাথায় বাড়ির পাশের একটি গাছে ঝুলতে দেখা যায় জসিমের নিথর দেহ। শোক কেটে না উঠতেই তিন মাসের গর্ভাবস্থায় স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন শ্বশুর-শাশুড়ি। আশ্রয় নেন অসহায় বাবার ভাঙাভিটায়।
বৃহস্পতিবার জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নাফিছা বেগমের। কেমন আছেন জানতে চাইলে কেঁদে ফেলেন নফিসা বেগম।
তিনি জানান, চলতি রোজার মাসে একদিনও ভাতের সঙ্গে কোনো আমিষ জোটেনি তাদের। কখনো শাকপাতা আবার কখনো আলুভর্তা দিয়েই ভাত খেয়ে রোজা রাখেন তিনি ও তার অসহায় বাবা। ইফতারের কথা জানতে চাইলে বলেন, কলে পানি (টিউবওয়েল) থাকলেই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।
অঝর কান্নায় ভাঙাভিটার করুণ দৃশ্য ঘুরে দেখান এই প্রতিবেদকে। বলেন, শরীরের অবস্থাও ভালো নেই। রোদে চোখের ভেতর অসহ্য জ্বালা-পোড়া করে। নারী সংক্রান্ত অন্যান্য রোগও কাবু করেছে। সরকারের দেয়া প্রতিবন্ধী ভাতার টাকাই তার বেঁচে থাকার সম্বল।
নিজের কষ্টের জীবনের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ছেলেটার যখন ৮ মাস বয়স তখন একদিন অজান্তেই পাশের বাড়ি চলে যায়। সেখানে মাটিতে পড়ে থাকা একটি চকলেট খেতে চাইলে সেটিও তাকে দেয়া হয়নি। পরে ঘর থেকে চাল নিয়ে গিয়েও পাশের দোকান থেকে ছেলেকে চকলেট কিনে দিতে ব্যর্থ হন এই মা। দুঃখে সেই মুহূর্তেই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার অবর্তমানে ছেলেটার কী হবে সেটা ভেবেই বেঁচে আছি।
দুঃখের সাগরে ডুবন্ত প্রায় এই নারীর সরকারসহ দেশের হৃদয়বানদের কাছে একটাই চাওয়া, তিন বেলা দু`মুঠো ভাত আর একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে সন্তানকে মানুষ করা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সাজিনুর মিয়া বলেন, নফিছা বেগমের মতো দুঃখী মানুষ এলাকায় নাই। আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে তাকে একটি ভিজিডি কার্ড করে দিয়েছি। দেশের হৃদয়বানদের সহায়তা পেলে হয়তো বাকি জীবনটা ডাল-ভাত খেয়ে কেটে যাবে এই অসহায় নারীর।