`হলি আর্টিসান বেকারিতে সেই রাতে হঠাৎ দেশি-বিদেশি অতিথিরাি আকস্মিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। মনে হচ্ছিল সম্ভবত ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু খানিকবাদেই ব্যাগ কাঁধে অস্ত্রধারীদের আক্রমণ। পাখি মারার মতো গুলি বর্ষণ করছিল। গুলিতে বিদেশি অতিথিদের অনেকের বুক-পিঠ ঝাঁঝরা। দিগ্বিদিক চিন্তা না করে ওয়াশরুমে পালাই। সারারাত ওই ওয়াশ রুমে থাকা ছিল নিদারুণ কষ্টের। একটুকু জায়গায় অনেকজন থাকায় অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। মারা যাবো ভেবেই দরজা ভাঙার চেষ্টা করি। পরে জঙ্গিরাই আমাদের বের করে আনে।`
রাজধানীর গুলশানে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিসান বেকারির সহকারী কুক মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার এলাকার আকাশ খান। ঢাকার কূনৈতিক এলাকায় অবস্থিত দেশি-বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় গতবছরের ১ জুলাই রাতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। আরও অনেকের মতো জিম্মি ছিলেন আকাশও। উদ্ধারকারীরা আসবেন এমন অপেক্ষায় ওয়াশরুমেই কেটেছে তার সারাটা রাত।
ওই হামলার প্রথম বার্ষিকীতে জাগো নিউজকে সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন তিনি। আকাশ খান বলেন, জঙ্গিরা ভেতরে ঢুকেই এলোাপাথাড়ি গুলি শুরু করে। রেস্তোরাঁয় আসা অতিথিরা যে যার মতো নিরাপদ স্থানে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ বাইরে বের হতে পারছিল না।
`আমিও পালানোর চেষ্টায় দৌড় দিতে গিয়েই থমকে যাই অস্ত্রধারীকে দেখে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একটি ছেলে বড় অস্ত্র হাতে অতিথিদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। এ দৃশ্য দেখে উল্টো দিকে দৌড় দিই। ঢুকে যাই ওয়াশরুমে। কারো দিকে তাকানোর সাহস ছিল না। গিয়ে দেখি আরও অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।`
ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনায় তিনি বলেন, “সেখান (ওয়াশরুম) থেকেই প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাদাত মেহেদী স্যারকে ফোন করি। বলি-স্যার সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। আমাদের বাঁচান। তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠান। ওরা পাখির মতো অতিথিদের মারছে। স্যার বললেন অপেক্ষা করো আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।“
আকাশ বলেন, `ভাবতেই পারিনি এখানে জঙ্গি হামলা হতে পারে! পরে বুঝতে পেরেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম ছিনতাইকারী কিংবা সন্ত্রাসীরা আসছে। নগদ যা পাবে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু না, ওরা পালায়নি। বরং উপস্থিত অতিথিদেরসহ আমাদের সবাইকে জিম্মি করে।`
`বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। গুলির আওয়াজ বন্ধ হলেও ভয়ে কারো টু শব্দটি করারও সাহস ছিল না। যদি জেনে যায় জঙ্গিরা আমরা এখানে পালিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরপর স্যারকে ফোন করি আর ফিসফিস করে বলতে থাকি স্যার কিছু একটা করেন, নইলে ওরা আমাদের বাঁচতে দেবে না। এখানে থাকা যাচ্ছে না। অক্সিজেনের প্রবাহ না থাকায় সবারই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পরে স্যারের পরামর্শে পানির কল ছাড়ি। সেখান থেকে বাতাস আসতে থাকে।`
ভয়াবহ জঙ্গি হামলা থেকে বেঁচে ফেরা আকাশ বলেন, এর মধ্যে অনলাইন পত্রিকা পড়ে জেনেছি এটা জঙ্গি হামলার ঘটনা। আরও ভয় পেয়ে যাই। স্যারকে আবারও ফোন করি। তখন তিনি বললেন, ভোর পর্যন্ত অপেক্ষ করো। কিন্তু অপেক্ষা যেন ফুরায় না। এর মধ্যে অনেকের জ্ঞান হারানোর দশা।
`আনুমানিক রাত ২টার পরপরই, জঙ্গিরা বাইরে থেকে দরজা টান দেয়। আমরাও ভেতর থেকে দরজা টেনে ধরে থাকি। ওরা বলে, যে ক’জন আছো বেড়িয়ে আসো, নইলে গ্রেনেড দিয়া উড়িয়ে দেবো। বেড়িয়ে আসি আমরা। দু`পাশ থেকে দু`টো ছেলে আমাদের অস্ত্র তাক করে ধরে রাখে। চেক করে বিদেশিদের নিয়ে যায়। এরপর আবার দরজা আটকে দিয়ে চলে যায়। দরজাটা লাগানোর পর অক্সিজেন প্রবাহ পুরোই যেন বন্ধ হয়ে যায়। আর কোনোমতে থাকতে না পেরে আমরা সিদ্ধান্ত নিই শ্বাসকষ্টে নয়, মরলে গুলিতেই মরবো। দরজায় আঘাত করি। ওদের একজন এসে দরজা খুলে দেয়।`
জাগো নিউজের সেঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল-আমাদের টার্গেট বাঙালি মুসলমান নয়, বিদেশিদের। যারা এদেশে এসে ইসলামী কালচার নষ্ট করছে। ওরা আরও নানান কথাবার্তা বলছিল। আমি এদিক-সেদিক চেয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। পাশাপাশি বেশ ক’টি লাশও পড়ে আছে।
`হঠাৎ একজন পাশ থেকে বলে উঠে, আমরা এখন বের হয়ে হচ্ছি। যারা বেঁছে আছো আলহামদুলিল্লাহ বলো। বিদায়, আবার দেখা হবে জান্নাতে,` বলতে থাকেন হলি আর্টিসানের সহকারী কুক আকাশ খান।
হলি আর্টিসান বেকারির ওই হামলায় দুই পুলিশসহ দেশি-বিদেশি ২০ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ছয়জন ওই হামলাকারী জঙ্গিও রয়েছে, যারা পরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত `অপারেশন থান্ডারবোল্টে` নিহত হয়।
আর বিদেশিদের মধ্যে ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানিজ ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন-ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন।
হামলার পরপর ১ জুলাই রাতেই এ হামলার দায় স্বীকার করে কতিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এদিকে জঙ্গি হামলায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি নতুন উদ্যামে চালু হয় হলি আর্টিসান বেকারি।