একদিকে জৌলুস অন্যদিকে অন্ধকার। একদিকে বৈভব এবং অন্যদিকে হাহাকার। লিওনেল মেসি এবং কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া গ্যাং লস মনোস।
তেল আর পানি যেমন একে অপরের সঙ্গে মেশে না, উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোও একে অন্যের পাশে শোভা পায় না; কিন্তু ঘটনাচক্রে শুক্রবার একই মোহনায় যেন মিলে যাচ্ছে বিপরীত বিষয়গুলো। ওইদিনই লিওনেল মেসি বিয়ে করবেন তার দীর্ঘদিনের বান্ধবী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোকে।
ফুটবল রাজপুত্রের রাজকীয় বিয়ের আসর বসছে তার নিজের জন্মস্থান, আর্জেন্টিনার সান্তা ফে রাজ্যের রোজারিওয়। অথচ যে বিলাসবহুল হোটেলে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে, তার চারদিক ঘিরে রয়েছে অপরাধের সাম্রাজ্য। আর্জেন্টিনার কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া চক্র ‘লস মনোস’ যে সাম্রাজ্য পরিচালনা করে, যেখানে দারিদ্র্য, ড্রাগ, রাহাজানি, খুন- এসব নিত্যদিনের ঘটনা।
গত পাঁচ বছরে এখানে নিহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। সান্তা ফে’র নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, আর্জেন্টিনায় অপরাধের যে হার, তার দ্বিগুণ রোজারিওয়। গত এক বছরে প্রতি লাখে গড়ে সাতটি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। মেসির বিয়ে যে হোটেলে, সেই সিটি সেন্টার কমপ্লেক্সের ঠিক পেছনেই লস মনোসের অবস্থান। রোজারিওর প্রকৃত ক্ষমতাই এই গ্যাং গ্রুপের হাতে। যারা একটি সমান্তরাল সরকারের মত রোজারিওর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে।
কেন এই এলাকাকে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিয়েছেন মেসি? স্থানীয়রা আগেই এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। রোজারিও স্থানীয় প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ অফিসার, কার্লোস দেল ফ্রেদে যেমন বলেছেন, ‘মেসির বিয়েটা বেশি করে সামনে নিয়ে আসছে আমাদের সমাজের বৈষম্যকে।’
মেসির বিয়ে উপলক্ষে দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে রোজারিওর পুরো চিত্র। যেখানে আর্থিক বৈষম্যের পাশাপাশি আরও যে ব্যাপারটা উঠে আসছে, সেটা হল অপরাধীদের সাম্রাজ্য।
এই তো গেল ১৭ জুনের ঘটনা। মেসির বিয়ে যেখানে হবে, সেই সিটি সেন্টার ক্যাসিনো হোটেল থেকে মাইল খানেকেরও কম দূরত্বে খুন হয়েছিলেন এক নারী। মোটরবাইকে করে এসে দুই সন্ত্রাসী চারজন নারীর ওপর গুলি চালায়। যে ঘটনায় মৃত্যু হয় ৫৬ বছর বয়সি এক নারীর।
ঘটনাচক্রে সেই নারী আবার ‘লস মনোস’ দলের নেতার বোন। এরপর থেকেই রোজারিওয় গুমোট পরিবেশ। সর্বত্র আতঙ্ক। আবার কখন ‘গ্যাং ওয়ার’ শুরু না হয়ে যায়। যার মধ্যেই রোজারিওয় এসে হাজির হচ্ছেন মেসি-আনতোনেল্লাসহ ফুটবল দুনিয়ার হুজ-হু-রা।
এ ছাড়াও থাকবেন বহু সেলিব্রিটি অতিথি। যাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। তবে মেসি নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত এক আর্জেন্টাইন সামরিক অফিসারের ওপর। তার অধীনে ২০০ নিরাপত্তরক্ষী হোটেল ঘিরে থাকবে। তবুও, তাতেও কি অস্বস্তি কমবে? নিরাপত্তার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন গত সপ্তাহেই বৈঠক করেছে মেসির পরিবারের সঙ্গে। যদিও সে বৈঠকের কোনো তথ্য জানা যায়নি।
তবে স্থানীয় প্রশাসন এখন পুরোপুরি প্রস্তুতি মেসির বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের। যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সব সক্ষমতা তাদের রয়েছে বলেও জানান তারা। শহরের প্রশাসক মনিকা ফেইন এএফপিকে জানিয়েছেন, ‘বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রোজারিও প্রস্তুত। নিজের শহর হওয়ার কারণেই লিওনেল এই শহরকে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন এবং এখানেই হয়তো তিনি স্বস্তিবোধ করবেন। আমাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সুন্দরভাবে আয়োজনের সব ব্যবস্থা নিয়েছি।’
মেসি এবং আন্তোনেল্লা- দু’জনই এক সঙ্গে রোজারিওয় শৈশব কাটিয়েছেন। বিয়ের দিনটায়ও তাই তারা ফিরে যেতে চেয়েছেন নিজেদের কৈশোরে; কিন্তু স্থানীয়রা এর পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। স্থানীয় এক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, মিকায়েলা লেনা নামে ২৪ বছর বয়সি এক তরুণী বলেছেন, ‘সত্যি বলতে কী, আমি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যখন শুনি ওরা এখানে এসে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। এটা তো একটা অনিরাপদ জায়গা। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’