মফস্বল শহরে বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া রেল লাইনের দু’পাশে ছিল আবাদি জমি। রোজা শুরু হতো শীতে। অনেকটা ধান কাটার পর। চাঁদ দেখতে ছুঁটে যেতাম রেল লাইনে। চাঁদ দেখা গেলেই রোজা শুরু। সঙ্গে তারাবির নামাজ।
ঈদের আনন্দটা শুরু হতো এ সময় থেকেই। মোবাইল ফোনের পরিবর্তে ঘরে ছিল টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ডফোন আর টেলিভিশন। অনেক সময় চাঁদ দেখা না গেলে বিটিভির খবরই ছিল ভরসা। একবার তো সাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার খবর পাওয়া গেল রাত ১০টায়। সেটাও বিটিভিতেই।
সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে সেই চাঁদ দেখার স্মৃতি। এখন রমজান কিংবা সাওয়াল মাসের চাঁদের খবর পাওয়া যায় ফেসবুকেই। ইট-কাঠের শহরে বড় বড় দালানকোঠার ভিড়ে চাঁদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। চাঁদ দেখার সেই আনন্দ এখন ছড়িয়েছে ফেসবুকের স্ট্যাটাস আর সেলফিতে। কেনাকাটাতেও কমতি নেই। হরেক রকম অফারের ঈদে কেনাকাটা শুরু হয় প্রথম রোজা থেকেই।
বাসায় হরেক রকম ইফতার তৈরি। রাস্তার মোড় থেকে বরফ কিনে ইফতারে একটু ঠান্ডার ছোঁয়া। প্রতিবেশিদের বাসায় ইফতার দেওয়া। পারস্পারিক সম্প্রতির বন্ধন। এখন ইফতার জমে ওঠে ফাস্ট ফুডে। রেস্টুরেন্টের টেবিলজুড়ে। ইফতারি আড্ডায় দেখা মেলে পুরনো বন্ধুদের। আনলিমিটেড সব অফারে ইফতার এখন আর সংযমে সীমাবদ্ধ নেই। মাঝেমধ্যে একদল উদ্যমী তরুণ-তরুণীর দেখা মেলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে। সাহরি বা ইফতারে নিজের সাধ্যমত থাকার চেষ্টা।
ফ্যাশন হাউজগুলোতে তরুণ-তরুণীদের জন্য পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির আদলে নানারকম পোশাক। নতুন পোশাকের সেলফি ভাসে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে। নানা ব্যস্ততার মাঝে এই উপলক্ষকে ঘিরে অনেকেরই দেখা মেলে শপিং মলে। নিকটাত্মীয় আর বন্ধুদের জন্য নতুন পোশাক কেনা থেকে শুরু করে চলে নানান কেনাকেটা। অনলাইন শপিং সাইটগুলোতে হরেক রকম অফার। কেনাকাটার ভিড়ে ঘরে বসে স্মার্টফোনেই কেনাকাটা সারছেন অনেকে। প্রিয় বন্ধুটিকে উপহার পাঠাচ্ছেন সেই অনলাইন অর্ডারেই।
বছরের অন্য সময় প্রতিবেশি বা বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া না হলেও ঈদের সময়টা মিস হতো না। নামাজ পড়েই এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর। এখন ঈদের দিনের ঘোরাঘুরির সেই আনন্দ কেবলই ভার্চুয়াল জগতে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর ইন্সটাগ্রামের ছবিতে দেখা মেলে ঈদের আনন্দ। তবে বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরতে ভোলেন না অনেকেই। পড়ন্ত বিকেলে স্কুল বা কলেজের মোড়ে দেখা মেলে পুরনো বন্ধুদের আড্ডা।
ঈদের সালামির যে আনন্দ তা এখনকার সময়ে দুর্লভ। সালামি এখন ঈদ উপলক্ষে কেনা স্মার্টফোনে। এর বাইরে হয়তো নতুন কোন উপহার। তবে গ্রামের ঈদের সালামি এখনো ঐতিহ্য। সেই সালামির টাকাতেই চলে মেলায় কেনাকাটা। পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে গ্রামের হাটে এখনো জমে ঈদের মেলা। ঈদের দিন থেকে শুরু করে এসব মেলা চলে দুই থেকে তিনদিন। হরেক রকম আসবাবপত্র, খাবার ও খেলাধুলার সামগ্রীতে ভরে ওঠে এসব মেলা। তবে শহুরে ঈদে এখনো এসব মেলার মত অনুষ্ঠানের দেখা না মিললেই বাহারি পোশাকের মেলা দেখা যায়।
প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনে ঈদের প্রভাব এখন বাস্তবের চেয়ে বেশি অন্তর্জালেই। তাই বলে আনন্দের কিন্তু কমতি নেই। তবে হারিয়ে যাচ্ছে পারস্পারিক সম্প্রীতির সেই বন্ধনগুলো। তবে অন্তর্জালের অনুভূতিতেও কিছুটা আনন্দ মেলে। ঈদের তোলা ছবি বা স্মৃতিতে বন্ধুদের লাইক-কমেন্টে। যে স্বজন বা বন্ধুটি আজ কাছে নেই; তারও দেখা মেলে অন্তর্জালে। আনন্দ ভেসে চলে ইথারে। ফেসবুক লাইভ বা ইমোতে কথা চলে ছবি দেখে দেখে। সে এক অন্যরকম আনন্দ।
যুগের সঙ্গে সভ্যতায়ও এসেছে পরিবর্তন। প্রভাব পড়েছে সামাজিক উৎসবে বা আনন্দ ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও। তবুও আনন্দের কমতি নেই, কেবল রকম বদলেছে। উল্লাসের কমতি নেই, তবে ধরন বদলেছে।