বছর ঘুরে আবারও এল খুশির ঈদ। সাম্য-মৈত্রী-শান্তি আর মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় ঈদুল ফিতর।
এদিন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায় মানুষ। তাদের ভেতর কোনো আমিত্ব থাকে না। ঈদুল ফিতর একই সঙ্গে উৎসব ও ইবাদতের আধ্যাত্মিক স্বাদ দিয়ে যায় প্রতিটি মুমিনের মনে। ধর্মীয় মূল্যবোধে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলিত করে। ঈদের আনন্দ-চেতনার ছোঁয়া মানবিকতা জাগ্রত করে।
ঈদ আনন্দ আর ফুর্তির নয়
ঈদ শুধু নিছক আনন্দ আর ফুর্তির নয়; এ থেকে আমাদের জীবনের জন্য শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছুই। ঈদুল ফিতর মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দ উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পবিত্র রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের শেষেই আসে খুশির ঈদ। পশ্চিমাকাশে উদিত শাওয়ালের রুপালি চাঁদ আনন্দের বারতায় উদ্বেলিত করে আমাদের মন ও প্রাণ। রোজাদারের মনে এর চেয়ে খুশি ওই মুহূর্তে আর কিছুই থাকে না। শাওয়ালের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মুমিন মুসলমানের ঘরে আনন্দের ঢল নামে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ রয়েছে। আমাদের আনন্দ হলো ঈদ। ‘
গান দেয় পূর্ণতা
পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশে ঈদের একটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঈদের আগের রাত থেকে টেলিভিশন, রেডিও থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের দোকান, মার্কেট সর্বত্র বাজতে শুরু করে, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ” এই একটি গানই ঈদ-উল-ফিতরের জানান দিতে যথেষ্ট।
কবি নজরুলের কালজয়ী গান
মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ও আনন্দের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন।
কালজয়ী সেই গানটি
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
প্রথম রেকর্ডিং
১৯৩১ সালে লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেক রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ।
ঈদ আনন্দের সঙ্গে ইবাদতও
ইসলামের উৎসবগুলো আনন্দের সঙ্গে ইবাদত হিসেবেও পরিগণিত। তেমনি দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর বা ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আনন্দকে বিলিয়ে দিতে বেশি করে দান-খয়রাত করা। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের (হোক সে শিশু) ওপর ফিতরা আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। আর ঈদুল ফিতর নামটির তাৎপর্যও এখানেই। আসলে প্রকৃত ঈদ ভোগে নয় ত্যাগে। ত্যাগের মহিমায় নিজেকে মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতেই ঈদ এবং এ ত্যাগই রোজার শিক্ষা। ঈদের নামাজের মাঠে আগমনকারীদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেন, ‘বাড়ি যাও আমি তোমাদের মাফ করে দিলাম। ‘
ঈদের বাণী
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। বাণীতে তাঁরা শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দেশবাসীর মঙ্গল কামনা করেছেন।
ঈদ মোবারক
হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে নিজের জন্য, দেশের ও বিশ্ব মুসলিমের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সব স্তরে রমজানের শিক্ষা বাস্তবায়ন করি। ঈদের চেতনায় মানবিকতাকে জাগ্রত করে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিই সবার সঙ্গে ভেদাভেদহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।