আগামী নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আগামী দুই বছরের জন্য প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ১৯৯১ সালের চলতি ভ্যাট আইনটিই বলবদ থাকবে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে সরকার। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভ্যাট আইনের বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সম্মুখে নতুন ভ্যাট আইনের বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। এ সময় অর্থমন্ত্রী, অর্থসচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী বিকল্প এই প্রস্তাবনার খসড়াটি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। এই খসড়ার ওপর কোনো সংশোধনী আনতে হবে কি না তা তিনি অধিকতর খতিয়ে দেখবেন। যেন নতুন করে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়।
জানা গেছে, আগামী শনিবার এই বিকল্প খসড়ার প্রস্তাবনা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২৮ জুন সংসদে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কথা বলবেন।
এনবিআর সূত্র জানায়, চলমান আইন বহাল থাকলে তার সঙ্গে নতুন করে যোগ হবে ভ্যাট অনলাইন। এর মানে ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন প্রদানসহ বেশিরভাগ কার্যক্রম অনলাইনে করতে হবে।
নতুন আইন বাস্তবায়ন না হলে রাজস্ব আদয়ে যে ঘাটতি দেখা দেবে সেটা কীভাবে পূরণ করা হবে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি সরকার। আগামীতে প্রয়োজন হলে এ খাত থেকে ঋণ নিতে পারবে সরকার। তাছাড়া পুরনো আইনের মাধ্যমেই আরও রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হবে।
সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনঅসন্তোষ, ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদের কারণে সরকার নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে গেল। কেননা, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটই শেষ বাজেট যেটি এই সরকার পুরো মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে পারবে। ফলে এই বাজেটের প্রভাব ২০১৮ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের যে বাজেট এই সরকার দেবে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সময় পাবে মাত্র তিন থেকে চার মাস। এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারির প্রথম দিকে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্তির তিন মাস আগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ হিসাবে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করেন। ওই বাজেটে বলা হয়, আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। এর আগে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে নতুন ভ্যাট আইন পাস করা হয়েছে। এই আইনে কিছু সেবা ও পণ্য ছাড়া প্রায় সব সেবা ও পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়। একই সঙ্গে সবস্তরে এই হারে ভ্যাট দেয়ার নিয়ম করা হয়।
এই আইন বাস্তবায়ন হলে পণ্য আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও বড় বড় দোকানে খুচরা পর্যায়েও ভ্যাট দিতে হবে। এতে ভ্যাটের হার বেশি পড়বে। যে কারণে ভ্যাট রি-ব্যাক দেয়ার নিয়ম করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখলে ১৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাটের অর্থ ফেরৎ দেয়া হবে। নতুন আইনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবধরনের পণ্য ও সেবার উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়।
দেশের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এই ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। তারা বলেছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হওয়ার মতো কাঠামো বর্তমানে নেই। এই আইন বাস্তবায়ন করা একেবারেই অসম্ভব। এটি বাস্তবায়ন হলে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বর্তমান চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এগুলোর দাম আরও উস্কে যাবে।
এছাড়া ব্যবসায়ীরা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামার হুমকি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যেভাবে হিসাব রাখতে হবে এই কাঠামো হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ীর রয়েছে, বাকি কারও নেই। ফলে তারা ভ্যাট রিবেট সুবিধা পাবেন না। এছাড়া পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতা কমে যাবে। তখন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভ্যাট আইনটি চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকেই বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তুতি না থাকায় ওই অর্থবছর থেকে আইনটি কার্যকর করা হয়নি। ওই সময়ে সিদ্ধান্ত ছিল আগামী অর্থবছর থেকে এই আইনটি কার্যকর করা হবে। এই সময়ের মধ্যে আইনটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হবে। কিন্তু ওই সময়ে ব্যবসায়ীদের কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি।
সূত্র জানায়, আগামী ২৯ জুলাই বাজেট পাস হওয়ার কথা ছিল। ঈদের ছুটির কারণে সেটি একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। আগামী ২৮ জুলাই বাজেট পাস হতে পারে। এর আগেই ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের ব্যাপারে জনবান্ধব সিদ্ধান্ত দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা পেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। তারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের কাঠামো চূড়ান্ত করবেন।
উল্লেখ্য, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ভ্যাট থেকে। যা মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬.৮ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের তৈরি ছকে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।