চালের দাম নিয়ে চালবাজি থামছে না। ফলে প্রায় এক বছর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চালের দাম। এতে নিদারুণ কষ্টে রয়েছে নিম্ন মধ্য আয়ের মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় চালের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা কথা বলা হলেও কমেনি দাম। উল্টো বেড়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। দায়ী অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে চালের মজুদ কমে যাওয়া, নিয়মিত বাজার মনিটরিং না হওয়া, চালের আমদানি হ্রাস পাওয়া এবং সর্বশেষ বৃষ্টির পানিতে হাওরের ধান নষ্ট হওয়ায় চালের দাম বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, সিলেটে হাওরে অস্বাভাবিক বন্যার কারণে ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু মোট উৎপাদনের তুলনায় এই পরিমাণ খুব সামান্য। পাশাপাশি সরকারি গুদামে যে ৬ থেকে ৭ লাখ টনের ওপর চাল মজুদ থাকার কথা তাও কমে এসেছে। এছাড়া বন্যার কারণে হাওর অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ টন চাল বিতরণ করেছে সরকার। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে।
এ সংকট কাটাতে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যদিও অনেক আগে থেকেই এ আশ্বাস দিলেও এখনও বাজারে আসেনি আমদানিকৃত চাল। ফলে ইচ্ছামতো সিন্ডিকেট করছেন চাল ব্যবসায়ীরা।
বুধবার রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক বছর থেকে এ বছর পাইজাম, লতা, স্বর্ণা এবং চায়না ইরি খ্যাত মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৮-১০ টাকা। মিনিকেট, নাজিরশাইল এবং বাসমতি চাল প্রতি কেজি ৪৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চায়না ইরি, লতা, বিনা-৭, বিআর-২৮, বিআর-৩৯, ৪৯, ৫১ এবং স্বর্ণাগুটি ও পাইজামজাতীয় মোটা চাল এক বছর আগে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩২-৩৪ টাকায়। আর এখন সেই একই চাল কিনতে ৪০-৫০ টাকায়। পাইজাম ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৫২ টাকা। আর নাজিরশাইল, বাসমতি ও মিনিকেটখ্যাত উন্নতমানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৬০ টাকায়।
কারওয়ানবাজারের বিক্রেতারা দুষছেন মিলারদের। সেখানকার চাল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনছি। আমরা কি লোকসান করে বিক্রি করব? আমরা যে দাম দিয়ে কিনি তা থেকে ২-৩ টাকা লাভে আমাদের বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া তো আমরা লসে পড়ে যাব। আগের সপ্তাহ থেকে এ সপ্তাহেও চালের দাম আরও ২-৩ টাকা বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন এ বিক্রেতা।
মারুফ হোসেন নামের এক ক্রেতা আক্ষেপ করে বলেন, চালের দাম বাড়তে বাড়তে এত বেশি বেড়েছে যে কদিন পর শুধু বড়লোকদের জন্য চাল বিক্রি হবে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষদের ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। আরেক ক্রেতা রাইসুল হোসেন বলেন, সরকার আমাদের ভাতেও মারছে কাপড়েও মারছে। ঈদ বাজারে কাপড়ের দাম বেশি; এদিকে চাল বাজারে চালের দাম বেশি। আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায় খাব কি?
এদিকে টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরে মোটা চালের ক্ষেত্রে দাম বাড়ার হার প্রায় ২৫ শতাংশ। এছাড়া ৯.৭৬ শতাংশ দাম বেড়েছে মাঝারি মানের এবং উন্নতমানের চালের দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। সাধারণ মানুষ খায় এ রকম চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এক বছরে। খাদ্যে বিশেষ করে ধান-চালে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর এ ধরনের উচ্চমূল্য কারও কাছে প্রত্যাশিত নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে কোন সিন্ডিকেট নেই বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চাহিদামতো ধানের অভাবে অনেক মিলে চাল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া লেবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শুল্ক কর বেড়েছে, লেবার খরচ বেড়েছে, চালের দাম তো বাড়বেই।
বাংলাদেশ চাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, আমাদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। তবে মিল মালিকরা চাইলে কিছু কম দামে আমাদের কাছে চাল দিতে পারেন। তারা কম দামে চাল দিলে বাজারে চালের দাম কমবে বলে আমার মনে হয়।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা বলেন, সিন্ডিকেট বলতে কিছু নেই। সিন্ডিকেট কথাটা হলো আমের ফরমালিনের মতো ভাইরাস। সবসময় সব জিনিসের দাম একই থাকবে এটার কোন মানে নেই।
তবে একশ্রেণির মিল-মালিক কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়েছে বলে মন্তব্য কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব)। এ সম্পর্কে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির উপর শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছে সরকার। চাল আমদানিতে এমন উচ্চ শুল্ক আরোপ করায় তা কমাতেও একটি চক্র এভাবে হঠাৎ করে চালের দাম বাড়াতে পারে। হাওরের বন্যা, মজুদ স্বল্পতা এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা বললেও আসলে তারা এসব সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়েছে। চাল আমদানির যে প্রক্রিয়া সরকার বলছে সেটিও অনেক ধীরগতির। তাই চাল সংকট নিরসনে এক সপ্তাহের মধ্যে চাল আমদানি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির উপর ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, শুধু সংকট নিরসন করলেই চলবে না, পাশাপাশি এ সময়ে যারা চাল মজুদ রেখেছেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে স্পেশাল পাওয়ার আইনে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে এ ধরনের অপরাধ আর কেউ না করতে পারে।
মঙ্গলবার বাজেট নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে চালের বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, চালের মজুদ বাড়াতে হবে। চালের শুল্ক উঠে যাবে, এ টাইপের কথা বন্ধ করতে হবে। দ্রুত বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের দাম বেড়েছে। তবে চাল আমদানির জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ। শিগগিরই চালের বাজার স্থিতিশীল হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।