টাইগার অধিনায়ক মাশরাফির ভাষায়, যে ক্রিকেট জাতিটির জন্মই হয়েছে ক্রিকেটের বিশ্ব আসরের ফাইনাল খেলার জন্য, সেই অস্ট্রেলিয়া বাদ পড়েছে সবার আগে। সর্বাধিক পাঁচবারের বিশ্বসেরা আর ভারতের সাথে যৌথভাবে সর্বাধিক দুইবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বিজয়ী অস্ট্রেলিয়া যতটা নিজেদের ব্যর্থতায় ছিটকে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। বৃষ্টিতে দুই ম্যাচ পণ্ড হওয়ায় গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়ে তারা ফিরে গেছেন নিজ দেশে।
আইসিসির মেগা ইভেন্টগুলোর বেশিরভাগ আসরে নকআউট পর্যায়ে গিয়ে বার বার না পারার গ্লানি বয়ে ‘চোকার’ তকমা গায়ে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও বিদায় নিয়েছে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় হওয়া প্রথম নকআউট বিশ্বকাপ (তখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নাম ছিল নকআউট বিশ্বকাপ) চ্যাম্পিয়ন প্রোটিয়ারা দুর্দান্ত সূচনার পরও এশিয়ার দুই দল পাকিস্তান ও ভারতের কাছে হেরেই বাদ পড়েছে এবার।
এবি ডি ভিলিয়ার্সের দলকে অনুসরণ করেছে ২০০০ সালে কেনিয়ায় হওয়া এ টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় আসরের বিজয়ী নিউজিল্যান্ডও। একবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বিজয়ী কিউইরাও শেষ চারের টিকিট পায়নি এবার। একইভাবে সেমির লড়াইয়ে নেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাও। এই চার চারটি সাবেক চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বিজয়ী দলের গ্রুপ পর্বে বাদ পড়া যেমন অনেক বড় ঘটনা, তারচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা বাংলাদেশের সেমিতে উঠে আসা।
সবার হিসাব-নিকেশ ভুল প্রমাণ করে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে উঠে এসেছে টাইগাররা। বলার অপেক্ষা রাখে না, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তো প্রশ্নই আসে না, এর আগে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি কোন ফরম্যাটেই আইসিসির কোন বিশ্ব আসরের সেমিতে খেলা হয়নি বাংলাদেশের।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে হওয়া সর্বশেষ বিশ্বকাপে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিল টাইগাররা। এবারের শেষ চারে উঠে আসার ঘটনাকে ব্র্যাকেটবন্দি করলে সেবারই প্রথম কোন বিশ্ব আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল মাশরাফির দল। অবশ্য তারও আগে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের নয় নম্বর আসরেও সেরা আটে ছিল বাংলাদেশ। তবে সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল নয়, গ্রুপ পর্ব শেষে সেরা আট দল আবার দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে খেলেছে সুপার এইটে।
কিন্তু নকআউট পর্বের কোয়ার্টারে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপই ছিল প্রথম। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আরও এক ধাপ ওপরে উঠে এবার শেষ চারে মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মোস্তাফিজরা।
১৯৯৯ থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপের পাঁচ আসরে দুইবার সেরা আটে জায়গা করে নিলেও ইতিহাস বলছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আগে কখনও সেরা চার তো বহুদূরে, শীর্ষ আটেও জায়গা হয়নি বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের সাফল্যের গ্রাফটা যখন থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে (২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট) তখন থেকে আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিই খেলেনি টাইগাররা। ২০০৬ সালে ভারতের মাটিতে হওয়া পঞ্চম আসরই ছিল শেষ অংশগ্রহণ। তারপর গত ১১ বছরে হওয়া শেষ দুই আসরে একবারও খেলার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ।
এবার র্যাংকিংয়ে শীর্ষ আট দলের মধ্যে জায়গা করে তবেই না আবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলছে টাইগাররা। দুই বছর আগে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ জিতেই ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে সেরা আট দলে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ।
র্যাংকিংয়ে সেরা আটের মধ্যে আট নম্বরে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে র্যাংকিংয়ে বড় ধরনের উন্নতি ঘটায় বাংলাদেশ। ওই একটি জয়েই পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে পিছনে ফেলে র্যাংকিংয়ে ছয় নম্বরে চলে আসে বাংলাদেশ।
মোদ্দা কথা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরুর ১৫ দিন আগেই র্যাং কিংয়ে ছয় নম্বরে উঠে আসে মাশরাফির দল। সেটাও বড় ধরনের উন্নতির পরিচায়ক। ছয় নম্বর দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে মাঠের লড়াইয়ে কিউইদের বীরের মতো হারিয়ে সেরা চারে জায়গা করে নিয়েছে মাশরাফি বাহিনী।
এটাকে মোটেই বিস্ময়কর উত্থান ভাবার কোনোই কারণ নেই। কোনো বৈশ্বিক আসরে র্যাংকিংয়ে ছয় নম্বর দল শেষ চারে জায়গা করে নেয়ার রেকর্ড আছে ভুরি ভুরি। ফুটবলে ছয়-সাত নম্বর দলের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ারও রেকর্ড আছে।
১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত লঙ্কানদের গায়ে বড় দলের তকমা লাগেনি। খুব চাঁছা-ছোলা বললে ছোট দলের তকমা নিয়েই বিশ্বসেরা হয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর অরবিন্দ ডি সিলভার দল। কাজেই র্যাংকিংয়ে সেরা চারে কিংবা পাঁচে থাকলেই সেই দল সেমিফাইনাল খেলবে, আর তার নিচের র্যা ঙ্কিংয়ের কোন দল খেলবে না এমন কোনো কথা নেই।
প্রিয় জাতীয় দল প্রথমবার সেমিতে খেলছে। বাংলাদেশে একটা অন্যরকম সাড়া পড়ে গেছে। ইতোমধ্যেই টাইগারদের সেমিফাইনালে ওঠা এবং ভারতের সাথে সেমির লড়াই ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়ে গেছে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ড্রয়িংরুম, বেড রুম ছাপিয়ে এখন রান্নাঘরেও ঢুকে গেছে ক্রিকেট আর বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলা প্রসঙ্গ।
অজপাড়ার অবুঝ কিশোর, গলির যুবক-তরুণ থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধবনিতার কোটি চোখ বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে। সবার উন্মুখ অপেক্ষা, কখন শুরু হবে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেমির লড়াই?
১৫ জুনের সেমিফাইনাল, তাই বাঙালির বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসের এক অন্যরকম দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সবার ভাবনায় এখন ১৫ জুনের সেমিফাইনাল। যে দল আগে কখনও শেষ চারে পৌঁছেনি, তাদের প্রথমবার সেমিতে খেলাই অনেক বড় ঘটনা। অর্জন ও প্রাপ্তি।
সে আলোকেই বলা, বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলাই অনেক কিছু; কিন্তু কথায় বলে না, মানুষের প্রত্যাশা, স্বাধ ও স্বপ্নের কোনো পরিসীমা নেই। তাই বাংলাদেশের কোটি ভক্ত-সমর্থক সেমিতে খেলা নিয়ে উদ্বেলিত ও রোমাঞ্চিত হলেও তাদের স্বপ্ন এখন সেমিফাইনালের সীমা ছাড়িয়ে ‘ফাইনালে’।
ভক্ত-সমর্থক ও দেশবাসী স্বপ্ন দেখতেই পারেন। কারণ, বাংলাদেশের সামনে আছে ফাইনালের হাতছানি। যেখানে প্রতিপক্ষ ভারত। র্যা কিংয়ে এক নম্বর না হলেও ব্যাটিং ও বোলিং শক্তি- সামর্থ্যরে বিচারে অনেকের মতোই বর্তমান সময়ের সেরা দল। অতি বড় ভারতবিরোধী বিশ্লেষকও মানছেন- এ মুহূর্তে বিশ্ব সেরা ব্যাটিং ভারতের। এছাড়া বোলিংটাও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ধারালো ও বৈচিত্র্যে ভরা। সবচেয়ে বড় কথা, সর্বাধিকসংখ্যক ম্যাচ উইনার ও ‘বিগ ম্যাচ’ প্লেয়ার এবং পারফরমার আছেন ভারতীয় লাইনআপে।
তাতে কী? ‘সেমিফাইনাল’- নামেই ফাইনালের পরশ মাখা। যে ম্যাচ সব সময়ই ফাইনালের হাতছানি। জিতলেই স্বপ্নের ফাইনাল। প্রতিপক্ষ কে? তার শক্তি কতটুকু? সামর্থ্য কেমন? এগুলো যে বিবেচনায় আসে না, তা নয়। আসে, কিন্তু সেমিফাইনাল তবুও স্বপ্নের ম্যাচ। বিশ্বের সব দলই ফাইনালে খেলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে সেমির লড়াইয়ে নামে।
বাংলাদেশের সামনেও আছে ফাইনালের হাতছানি। জিততে পারলেই ব্যাস। প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল। মানে ফাইনালের হাত মেলানো দূরত্বে থেকেই ১৫ জুন বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে মাঠে নামবে মাশরাফির বাংলাদেশ।
দল হিসেবে ভারত অনেক সমৃদ্ধ। প্রচণ্ড শক্তিশালী। ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যাটিং খুব সমৃদ্ধ। এক কথায় ব্যাটিং পাওয়ারহাউজ। সে সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে শক্তিশালী বোলিং ডিপার্টমেন্ট। তাদের পেস বোলিং আগের চেয়ে অনেক ধারালো।
তবুও শ্রীলঙ্কার কাছে গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচটি অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গিয়েছিল তারা। তবুও পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে দিয়ে মাঠে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় রেখেছে বিরাট কোহলির দল।
এমন এক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও কঠিন দলের সাথে সেমিফাইনাল, তাতে কি? স্বপ্ন দেখতে আর প্রিয় জাতীয় দলকে নিয়ে আশা করতে তো আর দোষ নেই। যেখানে ওই একটি ম্যাচ জিতলেই স্বপ্নের ফাইনাল। তাই তো কোটি বাঙালির চোখে এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল খেলার স্বপ্ন।
তারা জানেন, প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালী আর কঠিনই হোক না কেন, খেলা একটাই। একদিনই। ১৫ জুন বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনকে নিজেদের করে ফেলতে পারলেই, ব্যাস। সোজা ফাইনালে।
এমন নয় ভারতকে আগে কখনই হারায়নি বাংলাদেশ। হারিয়েছে। বিশ্বকাপেও হারানোর রেকর্ড আছে। শুধু হারানোই নয়। ভারতীয়দের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দেয়ার কৃতিত্বও আছে টাইগারদের।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, ২০০৭ সালে সর্বকালের সেরা উইলোবাজ শচিন টেন্ডুলকার, ড্যাশিং ওপেনার বিরেন্দর সেবাগ, প্রিন্স অব কলকাতা সৌরভ গাঙ্গুলী, মিস্টার ডিপেন্ডেবল রাহুল দ্রাবিড় আর তুখোর ফিনিশার যুবরাজ সিং থাকার পরও ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
১৫ জুন যে ১১ জন নামবেন, তাদের মধ্যে চারজন- মাশরাফি (৩৮ রানে ৪ উইকেট দখল করে ম্যাচ সেরা), তামিম (৫১), সাকিব (৫৩) ও মুশফিকই (৫৬) ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভাল বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তারা ছিলেন ঐতিহাসিক জয়ের স্থপতি।
আজকের অধিনায়ক মাশরাফি হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। তার ধারাল বোলিংয়েই ১৯১ রানের মামুলি পুঁজিতে অলআউট হয় ভারত। আর সেই রানের পিছু নিয়ে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন তিন তরুণ তুর্কি তামিম, সাকিব ও মুশফিক। তাদের তিন হাফ সেঞ্চুরিতেই ভারতের রান টপকে অবিস্মণীয় জয় পায় বাংলাদেশ। তারকায় ঠাসা ভারত ছিটকে পড়ে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে।
ছোট্ট একটি তথ্য, সেবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরেই বিদায় ঘণ্টা বাজে ভারতের। প্রথমবারের মতো সেরা আটে জায়গা হয়নি। দুই বছর আগে প্রায় একই দলকে নিজ মাটিতে তিন ম্যাচের সিরিজে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর রেকর্ড আছে টাইগারদের। এবার সেই দলের ফাইনাল স্বপ্ন ভাঙার সুবর্ণ সুযোগ টাইগারদের সামনে। সঙ্গে নিজেদের ফাইনাল খেলার হাতছানি।
মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মোস্তাফিজরা সে অধরা স্বপ্ন পূরণের পর্যাপ্ত সামর্থ্য রাখেন। এখন দরকার সামর্থে্যর সেরাটার যথাযথ প্রয়োগ। ১৫ জুন টাইগাররা ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে উঠলেই আবার ভারত বধ। প্রথমবারের মতো বিশ্ব আসরের ফাইনালে বাংলাদেশ।