স্নেহের স্বপ্ন
অপু আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। আজ একটি বিশেষ দিন। প্রতি ছ’মাস কিংবা এক বছর পর এই দিনটি আসে। অপু বাকি সবটা দিন শুধু এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করে। আজ পর্যন্ত অবশ্য তেমন ভালো কিছু হয়নি ওর জন্য। কিন্তু আজ তো হলেও হতে পারে। কিছুই তো বলা যায় না।
অপু দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। ছ’টা ত্রিশ বাজে। আশে পাশের ব্যাডের সব ছেলেরা এখনও কাঁথা মুরি দিয়ে ঘুমচ্ছে। অপু যেই এতিমখানায় থাকে তার নিয়ম অনুযায়ী সবাইকে সাতটায় উঠতে হবে। সেখানে অপু আজ ত্রিশ মিনিট আগেই উঠে পড়েছে। ভালোই হলো। আজকে সে আরাম করে বাথরুমটা ব্যবহার করতে পারবে। না হলে প্রতিদিন সকালে কে আগে যাবে বাথরুমে এটা নিয়ে মারামারি লাগে। এটাই স্বাভাবিক,এতগুলো ছেলে আর একটা মাত্র বাথরুম। এক পর্যায়ে সুপার এসে কে কী করেছে তা না জেনেই বেত চালানো শুরু করে। এই সুপারের বেত চালানোর খুব শখ। কারণে হোক বা অকারণেই হোক তিনি চোখের পাতা না ফেলেই ছেলেদের ওপর বেত চালিয়ে যেতে পারেন। তাই অপু জলদি জলদি তার বাথরুমের কাজ শেষ করল।
যেহেতু হাতে সময় আছে সে গোসলটাও সেরে নিলো। বেছে বেছে তার যেই শার্টটা সবচেয়ে ভালো সেটা পড়ল। চুল গুলোকে সুন্দর করে আঁচড়াল। আজকে ওদের দেখতে এতিম খানায় এমন কিছু বাবা মা আসবেন যাদের কোন সন্তান নেই। প্রতি ছ’মাস কিংবা এক বছরে এমন একটি দিনে ওনারা আসেন। সবার সাথে থাকেন, কথা বলেন এবং কিছু ভাগ্যবান ছেলে মেয়েকে নিয়ে যান তাদের পালক সন্তান হিসেবে। গতবার অপুর প্রাণের বন্ধু শরীফকে নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছেন তারা অনেক ধনী। ক’দিন আগে শরীফ এসেছিল ওদের সাথে দেখা করতে খুব সুন্দর একটা গাড়িতে চড়ে। অপু তো শরীফকে চিনতেই পারেনি দেখে।
কত সুন্দর জামা-কাপড় পড়া! একদম সাহেবের ছেলে। শরীফকে দেখে অপুরও খুব ইচ্ছে হয় তাকে কেউ কোন একদিন এসে নিয়ে যাবে। ইচ্ছে করে কাউকে আব্বু-আম্মু ডাকতে। কিন্তু কেন যেন আজ পর্যন্ত অপুকে কেউ পছন্দ করেনি। অপুর বয়স এখন দশ। তার বয়সের যারা ছিল তাদেরকে ঠিকই কখনো না কখনো কোন বাবা মা এসে নিয়ে গেছেন। কিন্তু অপু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কেন ওকে কেউ নিতে চায় না। তার এই ছোট্ট মাথায় এই কারণটি ঢুকতে চায় না। অপু নিজের রুম থেকে বের হয়ে দোতলার একদম কর্নারের একটা রুমে গেল। এটা একদম ছোট্ট বাচ্চাদের রুম, যাদের বয়স এক বছরের নিচে। অপু রুমের ভেতর ঢুকল। ওকে দেখে বাচ্চাদের যে সুপার মহিলা আছে সে একটু চোখ কুচকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।
অপু গিয়ে সাত নম্বর ব্যাডের সামনে এসে দাঁড়ালো। টুনি শুয়ে আছে এই ব্যাডে। এখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। অপু আলতো করে টুনির কপালে চুমু খেল। টুনি একটু নড়ে উঠল,আবার পর মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেল। টুনির বয়স এখন ছয় মাস। প্রায় পাঁচ মাস আগের কথা। অপু আর তার বন্ধুরা মিলে মোড়ের দোকানে গিয়েছিল কি যেন একটা কিনতে। ফেরার পথে ওরা যখন মাত্র গলির মাথায় এসেছে, তখন ছোট্ট একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পেল। তারা দেখতে পেল সামনের ডাস্টবিনের ওখানে ছোট-খাটো একটা ভিড়। আর কান্নার শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। অপু আর ওর বন্ধুরা ওখানে গেল, দেখল কে যেন একটা ছোট্ট বাচ্চাকে এই ডাস্টবিনের সামনে ফেলে চলে গেছে। সবাই মিলে সেটাই দেখছে। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে কেউ বাচ্চাটাকে কোলে নিচ্ছে না। অপুর খুব খারাপ লাগল। সে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিলো। নিয়ে এলো তাদের এতিমখানায়। অপুই বাচ্চাটার নাম রাখল টুনি।
সেই থেকে টুনি এখানে। টুনিকে এখানে আনার পর যেন অপুর জীবনটাই বদলে গেছে। সে প্রায় সময়ই টুনির সঙ্গে থেকে খেলে। টুনিও ওকে বেশ পছন্দ করে। অপুকে দেখলেই ফিক করে হেসে দেয়। বড় মায়াবী লাগে তখন টুনিকে। ঠিক দশটায় এক এক করে বাবা-মা’রা আসতে শুরু করলেন। সব বাচ্চাদের সাথে কথা বললেন অনেক আবার পুরনো কাপড়,কলম, চকলেট অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। সেগুলো বাচ্চাদের মাঝে ভাগ করে দিলেন। যাদের সাথে কথা বলে ভালো লাগল মনে নিবেন, তাদের নাম লিখে দিয়ে গেলেন। অপু টুনিকে নিয়ে খেলছিল। হুট করে মহিলা যে সুপার ছিলেন তিনি অপুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনার পিছনে একজন বাবা-মা দাঁড়ানো। সুপার অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ওনারা তোর টুনিকে নিতে এসেছেন। তোর টুনিকে ওনারা খুব ভালো রাখবেন। এই বলে সুপার অপুর কোল থেকে টুনিকে নিয়ে গেল। টুনি একটু নড়ে প্রতিবাদ করল। কিন্তু সুপার ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, তাই কিছু করতে পারল না।
অপু কিছু বলল না। তার চোখ থেকে শুধু দু’ফোঁটা জল পড়ল। তার অনেক খারাপও লাগছিল আবার ভালোও লাগছিল। খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে টুনি ওর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আর ভালো লাগছিল এই ভেবে যে টুনি তার বাবা-মা’র ভালোবাসা পেয়ে বড় হবে। তার মতো এতটা কষ্ট করে এতিম খানায় বড় হতে হবে না। এই অপেক্ষায় থাকতে হবে না যে কোন একদিন কোন এক বাবা-মা এসে তাকে নিয়ে যাবে। অপু ওর চোখের পানি মুছে বাইরে গিয়ে বসল, এই আশায় যদি ওর ডাক আসে। অপু বিকেল পর্যন্ত চুপচাপ এতিমখানার বারান্দায় বসে রইল। কিন্তু ওর ডাক আর এলো না। কিছু পর সে বেঞ্চের পাশে রাখা স্ট্রেচার দুটি নিয়ে তার ওপর ভর করে ধীরে ধীরে ওর রুমের দিকে যেতে শুরু করল। অপুর একটি পা নেই। জন্মের পর থেকেই ও একটি পা নিয়েই বড় হয়েছে। এতিমখানার সুপারের কাছে অপু শুনেছে ওর বয়স যখন দুই কি তিন মাস তখন কেউ তাকে এই এতিমখানার সামনে রেখে চলে যায়। এরপর থেকে ওর এখানে বড় হওয়া।
সবাই বলে অপুর একটি পা নেই। তাই বলে তার বাবা-মা তাকে এখানে ফেলে রেখে চলে গেছেন। আর এই কারণে নাকি কেউ তাকে পালক নিতে চায় না। তবে অপু এসব কথায় পাত্তা দেয় না। সে বিশ্বাস করে একদিন তার আসল বাবা মা আসবে। এসে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে, যেই স্নেহের জন্য সে এতটা আকুল হয়ে আছে। সেটি সে একদিন অবশ্যই পাবে। স্ট্রেচার দুটো ব্যাডের মাথার কাছে রেখে ক্লান্ত হয়ে অপু শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ করে আবার সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। বাবা-মার ভালোবাসা পাবার স্বপ্ন, মমতা পাবার স্বপ্ন, স্নেহের স্বপ্ন।