প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় জনগণকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সুন্দরবনের একটি এলাকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেশের উন্নয়নে তাঁর সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেন একটা বিষয় সবসময়ই খেয়াল রাখা হয় সুন্দরবন যাতে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’
প্রধানমন্ত্রী রবিবার (৪ জুন) সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষমেলা ২০১৭ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব বলেন। খবর বাসসের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সুন্দরবন যে আমাদের একটা ঐতিহ্য শুধু তাই নয়, এই সুন্দরবনের কারণেই কিন্তু বাংলাদেশ টিকে আছে। এই সুন্দরবন আরও যাতে বৃদ্ধি পায় সেজন্য আমরা আর্টিফিসিয়াল ম্যানগ্রোভ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি এবং সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তৃতি ঘটাবার জন্য ইতোমধ্যে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিভিন্ন পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি এবং বন অপরাধ দমনের জন্য স্মার্ট পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে কার্বন জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে এবং পরিবেশ পর্যটনের ক্ষেত্রের উন্নয়ন করা হয়েছে।’
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইশতিয়াক আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইসুল আলম মন্ডল এবং প্রধান বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা সাইফুল আলম চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দসহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আগামীকাল ৫ জুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘প্রাণের স্পন্দনে প্রকৃতির বন্ধনে।’
এদিকে ‘বৃক্ষরোপণ করে যে সম্পদশালী হয় সে’ শ্লোগান নিয়ে আজ থেকে তিনমাস ব্যাপী জাতীয় বৃক্ষরোপন কর্মসূচিও শুরু হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে একটি কাঁঠাল গাছের চারা রোপণ করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষমেলা ২০১৭ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন-২০১৭, বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০১৬ ও সামাজিক বনায়নের লভ্যাংশের চেক প্রদান করেন।
বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান এবং ঢাকার কলাবাগানের মোকারম হোসেন ব্যক্তিগতভাবে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার ২০১৭ এবং স্কয়ার ফার্মসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগতভাবে এই পুরস্কার লাভ করে।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে দুজনের হাতে সামাজিক বনায়নের লভ্যাংশের চেকও প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের ভারসাম্যকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে এই ভারসাম্য রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, প্রকৃতি যখন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তখন মানুষের জন্য তা বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।
প্রধানমন্ত্রী এই সময় জাতির পিতার দূরদর্শিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ‘পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ জারি করেন। তখন পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। এ অধ্যাদেশ ও প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছে আজকের পরিবেশ অধিদপ্তর।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ১৮(ক) সংযুক্ত করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে’।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকার দ্বিমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত সাড়ে ৮ বছরে আমাদের দেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। স্থানীয় দরিদ্র মহিলাসহ সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন অধিদপ্তর সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সাফল্য অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, সামাজিক বনায়নের আওতায় এ যাবৎ প্রায় ৭৯ হাজার ২৯৮ হেক্টর এবং ৬৬ হাজার ৪৭২ কিলোমিটার এলাকায় বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব বাগান প্রায় ৭৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকার বৃক্ষ সম্পদ আহরণ করা হয়েছে। এযাবৎ ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮০ জন দরিদ্র উপকারভোগীর মধ্যে ২৬১ কোটি ১৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, সামাজিক বনায়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সৃষ্টি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ সবুজায়নে ও দখলকৃত বনভূমি উদ্ধারে একটি সফল কৌশল হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৬ জারি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশকিছু এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ৪০টি বনসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা এবং জলাভূমি, হাওর, নদী, উপকূলীয় দ্বীপসহ ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়াও সরকার বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করেছে। এখানে ৫ প্রজাতির বিপন্ন সামুদ্রিক ডলফিন, পাখনাহীন শুশুক, কয়েক প্রজাতির তিমি ও হাঙর সংরক্ষণ এবং তাদের বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা না থাকলেও আমরা এর বিরূপ প্রভাবের নির্মম শিকার। বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। আমাদের সরকার ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় মোকাবিলায় ২০০৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজি এন্ড অ্যাকশন প্লান (বিসিসিএসএপি) যুগোপযোগী করছে।
তিনি বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ২০১০ সালে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করি। এ খাতে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গঠিত গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং এলডিসি ফান্ড হতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ প্রাপ্তির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন নেগোশিয়েশনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত করে।
আমাদের দেশে বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ইটভাটা জিগজ্যাগ এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটায় রূপান্তরিত হয়েছে। বাকি ইটভাটাসমূহও রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের প্রধান নদীসমূহ খনন করে তার নাব্যতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ কাজ সম্পন্ন করা গেলে নদীসমূহের প্রতিবেশ বা ইকোসিস্টেম আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে ও নৌ-পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীকে “প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করে তা ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাজারীবাগ ট্যানারিশিল্প সাভারের হরিণধরায় স্থানান্তর করা হয়েছে। দেশের সকল কারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইটিপি ছাড়া কোন নতুন কারখানার স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। শিল্প মালিকরা ইটিপিগুলো নিজেরা করলে তা ব্যবহার করতে চায় না। শুধু পরিদর্শনে সময় ব্যবহার হয়। তাই এগুলো সেন্ট্রালি তৈরি করে সকলকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হচ্ছে। হাজারিবাগের ট্যানারি সাভারে নিয়ে সেখানে ইটিপি সেন্ট্রালি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আবাসিক ফ্ল্যাট যেখানে করা হচ্ছে সেখানে রিসাইক্লিং ব্যবস্থা রাখার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাত হানার সময় সরকারের আগাম ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ঢাকার পাশেই গাজীপুর জেলার শালবনে প্রায় ৪ হাজার একর ভূমিতে ২০১৩ সালে স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যা-ইকো-পার্ক। এখানে দেশের সর্বপ্রথম প্রায় ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রোপওয়ে স্থাপন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আসুন, আমরা এ দেশকে সবুজে সবুজে ভরে তুলি। প্রত্যেকে অন্তত একটি করে বনজ, ফলজ ও ঔষধি চারা রোপণ করি এবং সবুজ অর্থনীতি নির্ভর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাই।