ডা. রেজাউল করিম : প্রত্যেক গর্ভবতী মা চায় তার কোলে সুস্থ্য সন্তানের আগমন হোক। মানব শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গ তৈরি হয় তার মায়ের গর্ভে। আর প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ সঠিকভাবে তৈরি হওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমানে পুষ্টি, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, পানি ইত্যাদি সরবরাহ জরুরি। এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে শিশুর জন্য দরকারী কোন কিছুর অভাব ঘটলে পরবর্তী জীবনে দীর্ঘমেয়াদী বা চিরস্থায়ী প্রভাব পড়ে। একজন মানুষের স্বাস্থ্য, মেধা, জন্মগত রোগ, বিশেষ বিশেষ অসুখে ভোগা অনেক ক্ষেত্রে মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠার সাথে সম্পর্কযুক্ত যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত।
পবিত্র রমজান মাসে গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা এবং গর্ভের শিশুর উপর তার প্রভাব নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে বিস্তর গবেষনা হয়েছে। বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভবতী মা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে অনাগত শিশুর জীবনে দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী স্বাস্থ্যগত প্রভাব পড়ে।
২০০৯ সালে তেহরান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিষেশজ্ঞরা এক গবেষণায় দেখেন গর্ভাবস্থায় রোজা রাখলে কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি দ্বিগুন এবং ছেলে সন্তানদের উপর এ প্রভাব অনেক বেশি। সৌদি আরবে ২০১০ সালে গর্ভাবস্থায় রোজা রেখেছিলেন এমন সাত হাজার তিরাশিজন মায়ের উপর গবেষণায় দেখা যায় তাদের গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার ওজনও কম। মাতৃজঠরে গর্ভফুলের মাধ্যমেই শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুস্টি ও দরকারি উপাদান সরবরাহ হয়ে থাকে। গর্ভফুলের ওজন কম হলে তা শিশুর উপর তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে বলে গবেষকরা মতামত দিয়েছেন।
এ সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় গবেষণাটি হয় ইন্দোনেশিয়ায় Indonesian Family Life Survey (IFLS) অবস্থানগত কারনে ইন্দেনেশিয়ায় প্রত্যেক বছর প্রায় সাড়ে তেরো ঘন্টা না খেয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে রোজা রাখার জন্য। বর্তমানে গড় বয়স ৩৪ বছর এমন চৌদ্দ হাজার মানুষ যাদের মায়েরা ১৯৬৬ সালের দিকে গর্ভাবস্থায় রোজা রেখেছিলেন, গবেষনায় দেখা যায় তাদের গড় উচ্চতা যাদের মায়েরা ওই সময় রোজা রাখেননি তাদের সন্তানদের চেয়ে কম এবং স্বাস্থ্য ক্ষীনকায়। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, করোনারী হার্ট ডিজিজ ও কিডনী রোগে ভোগার হারও বেশি। একই রকম গবেষনায় উগান্ডা ও ইরাকের গবেষকরা দেখেন গর্ভাবস্থায় দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকা মায়েদের সন্তানদের পরিণত বয়সে কানে শোনা, দৃষ্টি শক্তি ও মস্তিস্কের অনুধাবন শক্তি ক্ষীণ হয়। ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে ডাচ ও ১৯৫৯-১৯৬১ সালে চীনে দুর্ভিক্ষের সময় জন্ম নেয়া শিশুদের ক্ষেত্রেও এমন স্বাস্থ্যগত ফলাফল পাওয়া গেছে।
বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা:
একটি বিল্ডিং তৈরির সময় যদি সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি উপকরন সরবরাহ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে উক্ত বিল্ডিং এর স্থায়ীত্ব বা গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মায়ের গর্ভে একটি শিশু নির্ধারিত সময়কাল অবস্থান করার সুযোগ পায়। এই গুরুত্বপূর্ন সময়েই মানব শরীরের জীবন ধারণ, রোগ প্রতিরোধ, মেধা-মনন সবকিছুর প্রয়োজনীয় অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ যেমন স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকরী কোষ নিউরন, কিডনির নেফ্রোন, ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ বিটা সেল ইত্যাদি নির্দিষ্ট সংখ্যায় তৈরি হওয়া প্রয়োজন, কেননা জন্মের পর এ সমস্ত কোষ আর তেমন তেরি হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে Fetal Programming in Intra-uterine Life বলা হয়। মায়ের পেটেই তৈরি হওয়া এসব কোষকলা দিয়েই বাকি জীবন চালাতে হয়। কাজেই গর্ভবতী মা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে নির্ধারিত সময়ে শিশুর শরীরের মূল্যবান কোষ কলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নির্দিস্ট মাত্রায় সরবরাহের ব্যত্যয় ঘটে। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে শিশুর বাকি জীবনে। চিকিৎসকরা ওজন ভেদে গর্ভবতী মাকে স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে ৩০০-৫০০ ক্যালোরি বেশি খাদ্য গ্রহণ করতে বলেন। শুধু তাই নয় দিনে তিন বারের পরিবর্তে ছয় বার অর্থাৎ ঘন ঘন অল্প খাবারে গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ স্বাস্থ্যবান মানব জীবন-যাপনের পূর্বশর্ত।
ধর্মীয় ব্যখ্যা:
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলেমগন গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা বিষয়ে কোরান হাদিসের আলোকে মতামত প্রদান করেছেন। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা যারা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে শংকিত হতে পারেন বা যেখানে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে এমন মায়েদের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয় বলে আলেমগণ মতামত দিয়েছেন। পরবর্তীতে সমান সংখ্যক রোজা রেখে, সমসংখ্যক দিন একজন গরীবকে অন্নদান করে বা অন্য আমলের মাধ্যমে তা পূরণ করতে বলা হয়েছে। আমাদের দেশের বিজ্ঞ আলেমগন সম্মিলিত মতামত প্রদান করে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের মনের বিভ্রান্তি ও শংকা দূর করতে পারেন।
আমার ব্যক্তিগত মতামত:
চিকিৎসক হিসাবে আমার কাছে রোজা রাখা মানে এখন প্রায় ১৫ ঘন্টা না খেয়ে থাকা। একজন মুসলমান গর্ভবতী মা যদি জিজ্ঞাসা করে আমি রোজা রাখতে পারবো কি না (মানে রোজা রাখলে তার বা বাচ্চার সমস্যা হবে কিনা) আর একজন অমুসলিম গর্ভবতী মা যদি জিজ্ঞাসা করে আমি ২৪ ঘন্টায় ১৫ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে (ধরা যাক তাকে সকাল ৭টায় মিরপুর ১১ থেকে রওয়ানা দিতে হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে ৮টায় পৌঁছানোর জন্য, বেলা আড়াইটায় ছুটির পর কোন ম্যাডামের চেম্বারে কাজ করতে হয়, বাসায় যেতে রাত ১০টা) কোনো সমস্যা হবে কিনা, যদি পরীক্ষায় আসে গর্ভবতী মা ১৫ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে বাচ্চার কোনো সমস্যা হতে পারে কি না এই সব প্রশ্নের উত্তর তো চিকিৎসকের একই রকম দেওয়ার কথা। আর এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু একজন প্রসূতিবীদ বৈজ্ঞানিক দৃস্টিকোন থেকে দিতে পারে। কিন্তু লক্ষ করছি প্রসূতিবীদ ছাড়াও অনেকেই এ বিষয়ে ধর্মীয় আবেগ মিশ্রিত বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। রোগীর সামনে চিকিৎসক পুরুষ-মহিলা নন, হিন্দু-মুসলমান নন, ধর্মপ্রচারক নন, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী নন, সমাজসেবক নন। আর চিকিৎসকের কাছে রোগী সবচেয়ে পবিত্র ব্যক্তি।
কাজেই চিকিৎসক একজন গর্ভবতী মাকে বলতে পারেন, একই পরিমান খাবার (মোট ক্যালোরী) দিনে ৩ বারের পরিবর্তে ৬ বার খেলে ভালো, আর ১৫ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে। আমার জ্ঞানে যেখানে গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়ের সন্তানের ক্ষতি হওয়ার সামান্য সম্ভাবনা/ঝুঁকি যেখানে আছে, সেখানে রোজা বাধ্যতামূলক নয় এ ব্যপারে ইসলামে পরিস্কার বলা আছে। কাজেই গর্ভবতী মায়েদের রোজা রাখা না রাখা নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। গর্ভবতী মা রোজা না রাখতে পারলে অপরাধবোধের কিছু নেই। রোজা না রাখতে পারলে কি করনীয় তা ধর্মে বলা আছে।
আমরা শুধু গর্ভবতী মাকে পুস্টি, অর্থাৎ খাবারের ধরন ও খাবার গ্রহনের সময় সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক উপদেশ দিতে পারি। রোজা রাখা না রাখা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব রোগীর। বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে জেনেও গর্ভবতী মা রোজা রাখলে চিকিৎকের পূন্য হবেনা আর না রাখলেও চিকিৎসকের পাপ হবে না।
লেখক
ডা. রেজাউল করিম
সহকারী অধ্যাপক
প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়