রির্পোট: রাশেদ রাশা.
নাগরিক সাংবাদিক.
লৌহজং নদী,
টাঙ্গাইল জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনার একটি শাখা নদী। প্রায় ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলি সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কয়েকশত বর্ষ ধরে টাঙ্গাইল বাসীর সুখদুঃখের সাক্ষী হয়ে আছে এ নদী।
এই লৌহজং নদীর তীরেই জন্মেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শুয়ে আছেন এ নদীর তীরেই।
আরো জন্মেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ‘৭১ এ নদী পাড়ি দিয়ে মাওলানা ভাসানী গিয়েছিলেন কোলকাতা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এই নদীর পাড়েই ১৯৭৬ সালে মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা বাধের বিরুদ্ধে করেছিলেন লংমার্চ।
এতসব স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকা এই ঐতিহাসিক লৌহজং নদী আজ মৃতপ্রায়। আজ এই লৌহজং নদী শুধু নামেই আছে, কিন্তু নেই তার পুরোনো রুপ, তার স্বাভাবিক প্রবাহ ও প্রশস্ততা। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবৈধ দখলের কারনে লৌহজং নদী আজ মানচিত্র হতে বিলীন হতে বসেছে।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের সুত্রে জানা যায় অতীতে ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লৌহজং নদীর প্রস্থ ছিলো প্রায় ৩০০ ফুট। কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারনে বর্তমানে এ নদীর প্রস্থ এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৮০ ফুটে। পূর্বে যেই লৌহজং নদীতে নিয়মিত লঞ্চ ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতো, আজ পর্যাপ্ত প্রশস্ততা ও পানি প্রবাহের অভাবে সেখানে ছোট নৌকাও ঠিকভাবে চলাচল করতে পারেনা। পূর্বেকার মৎস সম্পদের আধার লৌহজং নদীতে আজ মাছের অভাবে না খেয়ে মরতে বসেছে টাঙ্গাইলের জেলে সম্প্রদায়। লৌহজং নদীর এমন অপমৃত্যু টাঙ্গাইল জেলার জন্য কেবল দুঃখজনকই নয় বরং তা পরিবেশের জন্যও হুমকিস্বরুপ।
বহুবছর ধরে টাঙ্গাইল বাসীর প্রানের দাবি ছিলো অপদখলমুক্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে লৌহজং নদীকে উদ্ধার করে এর স্বাভাবিক স্রোতধারা আবার ফিরিয়ে আনা হোক। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, সংঘবদ্ধতা ও প্রশাসনের অবহেলার কারনে এই দাবি বাস্তবায়ন কখনওই সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
সময়ের সাথে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিগণ পরিবর্তিত হলেও লৌহজং এর করুন অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। তবে সবার থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম টাঙ্গাইলের বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব মাহবুব হোসেন।
নদী-খালের জেলা বরিশালে বেড়ে ওঠা জনাব মাহবুব হোসেন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব হাতে নিয়েই লৌহজং এর কান্না এবং এ নদীকে নিয়ে মানুষের হাহাকার অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি দায়িত্ব গ্রহন করেই ঘোষণা দেন যে তিনি অপদখল মুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই নদীকে অবশ্যই উদ্ধার করে ছাড়বেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংঘবদ্ধকরণ এর অভাবে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে উঠছিলো না। প্রায় আড়াই বছর ধরে একের পর এক চেষ্টা চালিয়েও কোনো আশানুরূপ ফল লাভ সম্ভব হচ্ছিল না।
পরিস্থিতি যখন এমন ঠিক তখনই টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক তার নিজ জেলা বরিশালে ৪৭০০০ মানুষের অংশগ্রহণে বিখ্যাত খাল “জেলখাল” পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের কথা জানতে পারেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে সংগঠিত “জনগণের জেলখাল পুনরুদ্ধার” কর্মসূচী ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়, জাতিসংঘ, এটুআই ও গণমাধ্যম কতৃক ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে বরিশাল জেলাবাসী দেশের বাকি ৬৩ জেলার সামনে নিজেদের অনন্য হিসেবে স্থাপন করেছে।
আর এই গণজাগরণের নেপথ্যে বরিশাল জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি যারা অভাবনীয় ভূমিকা পালন করেছে, তারা হলো বরিশালের একঝাক তরুন সিটিজেন জার্নালিস্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ও দৃষ্টান্তরূপ ব্যবহার নিশ্চিত করে কিভাবে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় তা বরিশালের সিটিজেন জার্নালিস্ট রা তা জেলখাল পুনরুদ্ধার কর্মসূচীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। তাই তারা ইতিমধ্যে সরকার, এটুআই, জাতিসংঘ ও গণমাধ্যম কতৃক প্রশংসিত হয়েছে।
এ ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক, জনাব মাহুবুব হোসেন বরিশাল জেলা প্রশাসক, জনাব ডঃ গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান এর সাথে যোগাযোগ করেন এবং এ ঘটনার আদ্যোপান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হন। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপ, টাঙ্গাইল প্রতিষ্ঠা করেন এবং জেলখাল ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা, তার নতুন কর্মপরিকল্পনায় সফলতা আসতে থাকে। টাঙ্গাইল সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও গণজাগরণের নতুন উদ্যম তৈরি করতে থাকে। প্রশাসন ও সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপের সম্মিলিত প্রয়াসে নতুন নদী উদ্ধারের নতুন কর্মপরিকল্পনা আরো বেগবান হতে থাকে। আর জনগণও নতুন করে লৌহজং নদীকে আগের রুপে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
অবশেষে গত ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখ “লৌহজং নদী উদ্ধার অভিযান” এর তারিখ ধার্য করা হয়। জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা অনুসারে ধাপেধাপে তাদের কাজ আগাতে থাকে। মানচিত্র ধরে ধরে লৌহজং নদীর পূর্বের অবস্থান গুলো চিন্হিত করা হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতায় সফল হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক বরিশাল জেলা প্রশাসকের নিকট বরিশাল সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপের একটি দল আহবান করেন যারা নদী উদ্ধারের টাঙ্গাইল বাসীর নিকট বাড়তি অনুপ্রেরণার কারন হয়ে দাঁড়াবে।
তাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুটি দল বরিশাল থেকে টাঙ্গাইল পৌঁছায়। অগ্রগামী দলে ছিলেন ৯ জন সিটিজেন জার্নালিস্ট এবং বরিশাল জেলা প্রশাসনের ১০ জন প্রতিনিধি যারা ২৮ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখ দিবাগত রাত ২ টায় টাঙ্গাইল পৌঁছায়। আর পরবর্তী দলটি পৌঁছায় অভিযানের দিন দিবাগত রাত ৩ টায়, যে দলে ছিলেন ২৯ জন সিটিজেন জার্নালিস্ট এবং ২ জন জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি।
অগ্রগামী দলটি অভিযানের আগের দিন অভিযান শুরুর নির্ধারিত এলাকা পরিদর্শন করে এবং পরবর্তীতে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষে একটি অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া ২৮ তারিখ রাতে টাঙ্গাইল ডিসি লেকে আয়োজিত “শেষমুহুর্তের কর্মপরিকল্পনা সভা”-য় অংশ নেয়। আর অভিযানের দিন আসা দলটি নির্দিষ্ট টিশার্ট পড়ে ব্যানার নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে এবং অভিযানের জন্য জনসচেতনতা ও জনসংযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও দলদুটি কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে কাজ করে কাজের গতিকে আরো বেগবান করে। সেইসাথে “পরিবর্তন চাই” এর মতো পরিবেশবাদী সংগঠন গুলোও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করে।
অভিযানে সকল শ্রেনী, পেশার মানুষ, নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে একই সাথে নদী উদ্ধার অভিযানে কাজ করে। সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সকলের অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। সকাল ৯ টা থেকে অপদখলকারী দের স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। কোনকোন অপদখলকারী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সকলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নিজে থেকেই তাদের স্থাপনা সরিয়ে নেন। এছাড়াও উক্ত কার্যক্রমে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। নিজ শালীনতা বজায় রেখে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে সমাজের উন্নয়নে সমানতালে অবদান রাখা যায় তারই আরেকটি উদাহরণ হলো টাঙ্গাইলের “লৌহজং নদী উদ্ধার অভিযান”।
এই পুরো গণজমায়েত এর সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা প্রতক্ষভাবে সংগ্রহ করেন।
এছাড়াও Barisal Fb TV এবং Tangail Fb TV এর মাধ্যমে সারাদেশে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ফলে যারা যেকোনো কারনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেনি তারাও এ ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছেন।
আর এই কার্যক্রম টি সরকার ও এটুআই এর প্রত্যক্ষ তদারকিতে ছিলো।
প্রবীন রাজনীতিবিদ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গণমাধ্যমের সামনে লৌহজং নিয়ে তার বিভিন্ন অতীত স্মৃতিচারণ করেন এবং সেইসাথে ঘোষনা দেন যে এই নদী পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক সহযোগিতা তা করবেন।এছাড়াও তিনি বরিশাল জেলা প্রশাসক ডঃ গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান ও বরিশাল সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
অন্যদিকে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক জনাব মাহবুব হোসেন বলেন,
” এখানেই শেষ নয়,বরং এখান থেকে শুরু হয়ে ভবিষ্যতে পুরো ৭৬ কিলোমিটার নদী উদ্ধারের পরেই এই কার্যক্রম শেষ হবে।”
সেইসাথে তিনি আশ্বাস দেন যে উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন দের বিকল্প জায়গায় আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
এছাড়া টাঙ্গাইল সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপ ও বরিশাল সিটিজেন গ্রুপের সদস্যরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে একই সাথে কাজ করার ফলে দুই জেলার সিটিজেন জার্নলিস্ট দের মধ্যে ভাতৃত্বের যে বন্ধন তৈরি হয়েছে তা ভবিষ্যতেও যেকোনো উন্নয়নমুখী কাজে বজায় থাকবে।