রমজান আলী পেশায় দিনমুজর। স্ত্রী রওশন আরা গৃহিণী। নিভৃত পল্লীর একটি ভাঙাচোরা মাটির ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে তাঁদের বাস। আবাদি কোনো জমি নেই। ধানক্ষেতে মজুরি করে, অন্যের বাড়িতে শ্রম খেটে, কখনো বা রিকশা চালিয়ে চলে রমজান আলীর সংসার। উপার্জন হলে খাবার জোটে, না হলে উপোস থাকতে হয়। হতদরিদ্র এই দম্পতির তিন সন্তানই দারুণ মেধাবী।
বড় মেয়ে সুলতানা রাজিয়া রূপা ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায়। এখন সে শেরপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট মেয়ে রুমানা জান্নাত এবার এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। আর ছেলে রিয়াজ হাসান অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৫সহ মেধাবৃত্তি পেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
রূপার স্বপ্ন, সে ব্যারিস্টার হবে। রুমানা জান্নাত চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। রিয়াজের ইচ্ছা প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে বড় বাধা দারিদ্র্য। টাকার অভাবে রুমানার কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তিন মেধাবী সন্তানের লেখাপড়া আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় বাবা-মা।
শেরপুর শহর থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী বাজার সড়কের কদমতলী বাজারের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তায় প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই রমজান আলীর বাড়ি। মেয়েদের লেখাপড়ার কারণে এলাকার সবাই রমজান আলীকে এক নামে চেনে। রমজান বলেন, ‘দিনমজুরের কাজ এখন সব সময় পাওয়া যায় না। প্রায়ই বেকার বইসা থাকি। ৫ জুনের সংসারের খরচ চালাইন্না আমার জইন্য পাহাড় সুমান। তার ওফরে ছেলে-মেয়েগুলা নেহাপড়ায় ভালা অওয়নে পড়ছি বিফদে। তাদের মুহের দিহি চাইলে খুব খারাপ নাগে। পুনাইগুলা পড়বার চায়। বউয়েও পড়াবার চায়। কিন্তুক আমার তো সামর্থ্য নাই। অভাবের নাইগ্গা বেশ কয়বার ওগর নেহাপড়া বন্ধ করবার চাইছিলাম। কিন্তু বউ আর সমাজের কিছু ভালা মাইনসের নাইগ্গা পারি নাই। ’
রমজান বলেন, ‘জানি না আর কতদূর যাবার পারমু আমার পুলাপানেগরে নিয়া। যুদি আমার পুলাপানেগরে নেহাপড়ার নাইগ্গা কোনো সহযোগিতা পাইতাম, তাইলে তাদের স্বপ্ন যেমুন পুরাণ অইতো, আমিও তেমনি বাইচ্চা যাইতাম। যুদি একটা স্থায়ী কামাইর ব্যবস্থা অইতো তাইলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান অইতো। ’ তিনি বলেন, ‘নন্নী সড়ক এহন পাকা অইছে। যুদি একটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাইতাম, তাইলে ওই কামাই দিয়ে সংসার চলতো, পুলাপানের নেহাপড়ার ব্যবস্থাও করবার পাইতাম। কোনো সমস্যা অইতো না। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেড় বছর আগে রমজান আলী অভাবের তাড়নায় দুই মেয়েকেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর স্ত্রী রওশন আরার সঙ্গে ঝগড়াও হয়। রওশন আরা সন্তানদের লেখাপড়া করানোর দাবি মেনে না নেওয়ায় স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে বাপের বাড়ি রাজনগর গ্রামে চলে যান। সেখানে তিন মাস থাকার একপর্যায়ে স্থানীয় ‘ডপস’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সেনা সদস্য শাহীন মিয়ার সহায়তায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার শর্তে রওশন আরা স্বামীর বাড়ি ফিরে আসেন। পরে বড় মেয়েকে তাদের সহায়তায় শেরপুর সরকারি কলেজে ভর্তি করানো হয় এবং রুমানা ও রিয়াজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও মেধাবী ওই শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়।
নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়েগুলো (রমজান-রওশনের) সবাই মেধাবী। দরিদ্র ঘরে এমন মেধাবী সন্তান নিয়ে রমজানও বিপদে পড়েছেন। আমরা ছেলে-মেয়েদের বিনা মূল্যে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছি। তাদের জন্য কিছু করা গেলে পরিবারটি উপকৃত হবে। এরাই হয়তো একদিন সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবে। ’
রমজান আলীর তিন সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়টি কালের কণ্ঠ সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের নজরে আসে। তিনি জানান, বসুন্ধরা গ্রুপ এসব মেধাবী সন্তানের লেখাপড়ার জন্য রমজান আলীর পাশে দাঁড়াতে চায়। কালের কণ্ঠ শুভসংঘের মাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে রমমজান আলীকে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য শিগগিরই একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে দেওয়া হবে।
রওশন আরা এমন সংবাদ শুনে বলেন, ‘আল্লার দুইন্নায় অহনও বালা মানুষ আছে। মুনে অইলো আমগরে মাথা থাকিন বড় পাথ্থড়ডা নাইম্মা গেল। ’ রমজান আলী ও তাঁর ছেলে-মেয়েদের মুখেও এ সময় হাসি ফুটে ওঠে।