এই সময়ে ভোরের হালকা কুয়াশা আর সন্ধ্যার পর শীতল বাতাস জানান দিয়ে যাচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে উঠছে ক্রমেই। সঙ্গে ত্বকও হয়ে পড়ছে নির্জীব। কারণ শীতের রুক্ষ বাতাস কেড়ে নেয় ত্বকের কোমলতা। তাই শীতের শুরু থেকেই ত্বকের চাই বিশেষ পরিচর্যা। শীতে কীভাবে আপনার ত্বকের যত্ন নিবেন, সেই পরামর্শ নিয়ে এবারের মূল ফিচার। লিখেছেন সাবেরা সুলতানা।
প্রকৃতি এখন সেজেছে নতুন রূপে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রূপচর্চায়ও যে পরিবর্তন চাই। শীতের আমেজ সেভাবে শুরু না হলেও প্রকৃতির রুক্ষতা বাড়ছে একটু একটু করে। এ সময়টার শুষ্ক ভাব আমাদের ত্বকে বেশ প্রভাব ফেলে। শুষ্ক আবহাওয়া ও ধুলো-ময়লায় ত্বক হয়ে ওঠে রুক্ষ ও শুষ্ক। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে হয় ত্বকের পরিবর্তন। এ সময় শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ত্বকের ময়েশ্চারাইজার কমে যায়। এর ফলে ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে ওঠে এবং বলিরেখা দেখা দেয়। তাই এই সময় ত্বকে ঘন ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে, যেন ত্বক শুষ্ক হয়ে না ওঠে। এ ছাড়া শুষ্ক আবহাওয়ায় ধুলো-ময়লা বেশি থাকে। ফলে ময়লা জমে ত্বকে মৃত কোষের সৃষ্টি হয়।
শীতে অনেকে প্রতিদিন গোসল করতে চান না। এটা ঠিক নয়। গোসল না করলে ধুলো-ময়লা জমে আমাদের লোমকূপগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ত্বকে ব্রণ হয় এবং নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। প্রয়োজন হলে হালকা কুসুম গরম পানির সঙ্গে নিমপাতা সিদ্ধ পানি মিশিয়ে প্রতিদিন গোসল করতে হবে। ফেসিয়াল ত্বকের যত্নের জন্য জরুরি; কিন্তু তা হওয়া চাই সঠিক উপায়ে। এ জন্য নিজে না করে বিউটি স্যালুনগুলোতে ফেসিয়াল করানো ভালো। ত্বককে সজীব রাখতে শুষ্ক আবহাওয়ায় ১৫ দিন অন্তর ফেসিয়াল এবং মেনিকিউর-পেডিকিউর করা উচিত। তৈলাক্ত ত্বকে ময়লা বেশি জমে। যাদের ত্বক তৈলাক্ত তারা প্রতিবার ক্লিনজার বা ফেসওয়াস দিয়ে মুখ ধুয়ে লোশন লাগাবেন। যাদের ত্বক কিছুটা শুষ্ক তাদের একটু ভারী ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে। এ সময় ধুলোবালি থেকে চুল খুব তাড়াতাড়ি রুক্ষ হয়ে ওঠে। চুলের ত্বকে ময়লা জমে সৃষ্টি হয় খুশকির সমস্যা। ফলে ত্বকে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না এবং চুল ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। নির্জীব হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করে চুল। তাই একদিন পর পর চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া উচিত। খুশকি বেশি হলে তা মাথার ত্বকে ছত্রাকের মতো জমে যায়। এ থেকে ত্বকের ওপর ব্রন ও পাঁচড়া হতে পারে। যাদের খুশকির সমস্যা আছে তাদের অ্যান্টি ডেনড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া চুলের রুক্ষতা কমাতে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার চুলে তেল ম্যাসাজ করে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হবে এবং ১৫ দিন অন্তর পার্লারে গিয়ে হেয়ার ট্রিটমেন্ট করালে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
ত্বকের অসুখ
শীতে শুধু সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট নয়, ত্বকেরও সাধারণ কিছু সমস্যাও দেখা দেয়। জেরোসিস বা ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ইকথায়োসিস বা দেহের বিভিন্ন অংশে স্কেলি বা মাছের আঁশের মতো হওয়া এবং স্ক্যাবিস বা খোস-পাঁচড়া—এ সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান। আসুন এ সমস্যাগুলো কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় জেনে নিই।
জেরোসিস
এক্ষেত্রে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়াজনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন চুলকানি ও খুসকি দেখা যায়। যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে, তবে বয়স্করা বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের জেরোসিস হয় বেশি। তাই ত্বককে আর্দ্র রাখাই হবে মূল চিকিত্সা, এ ক্ষেত্রে তেলজাতীয় জিনিস ইমোলিয়েন্ট ত্বকে ব্যবহার করা যায়। ইমোলিয়েন্ট হলো অলিভ ওয়েল বা জলপাই তেল, বহুল ব্যবহূত সরিষার তেল বা নারকেল তেল। এ ছাড়া অয়েন্টমেন্ট যেমন ৫-১০ ভাগ ইউরিয়া ত্বকে মাখা যায়। ঠোঁট বা ত্বকের যেকোনো অংশে ফাটা রোধে বা এর চিকিত্সায় গ্লিসারিন আমাদের দেশে বহুল ব্যবহূত হচ্ছে।
ইকথায়োসিস
ত্বক শুষ্ক হয়ে মরা চামড়ার মতো আঁশ ওঠে। সাধারণত হাত ও পায়ে বেশি হয়। চিকিত্সা জেরোসিসের মতোই, এ ছাড়া ১-৫ ভাগ স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ব্যবহার করা যায়। শুষ্ক ত্বকের চিকিত্সায় মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ডিজিজ মডিফাইং এজেন্ট খুব জরুরি নয়। লোকাল বা শুষ্ক জায়গা আর্দ্র রাখলেই হলো।
ত্বক কালো হওয়া
শীতে শরীর গরম রাখার উদ্দেশে আমরা সূর্যের আলোয় রোদ পোহাই। এ ছাড়া বিভিন্ন উত্সবে কসমেটিকসের ব্যবহারও এ সময় বেড়ে যায়। এ সবই ত্বকে হাইপার পিগমেন্টেশন করে ফলে ত্বক কালো হয়ে যায়। আমাদের দেশে যে কসমেটিকস পাওয়া যায় তা ত্বকে সংবেদনশীলতা তৈরি করে কি না জানা যায় না। এ ছাড়া কোন ত্বকে কী ধরনের কসমেটিকস ব্যবহার করা যায় সে ব্যাপারেও আমরা ততটা সচেতন নই। কসমেটিকস লাগানোর পর রোদে না যাওয়াই ভালো। যদি যেতেই হবে তবে সানব্লকার বা সান প্রটেকটিং ফ্যাক্টর ১৫ বা তার উপরে মেখে বের হওয়া ভালো। এ ব্লকার সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে।
খুশকি
শীতে খুশকি বাড়ে। এ জন্য মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করলে ভালো হয়। কিটোকোনাজল, অ্যালোভেরা বাটার শ্যাম্পু ব্যবহার করা যায়।
এছাড়া এসময় পুরোনো চর্মরোগ যেমন সোরিয়াসিসে স্কেলিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
সহজ কিছু সমাধান
* শীতে গোসলের সময় অত্যধিক গরম পানি ব্যবহার করবেন না। গরম পানি ত্বকের তেল শোষণ করে ত্বককে শুষ্ক করে তোলে। তাই এই শীতে গোসলের সময় ত্বকের জন্য সহনীয় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন।
* প্রতিদিন গোসলের আগে অয়েল ম্যাসাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নারকেল তেল, বাদাম তেল (আমন্ড অয়েল), তিলের তেল বা যেকোনো ভালো মানের হারবাল তেল ব্যবহার করতে পারেন। সম্ভব হলে অয়েল ম্যাসাজের আধ ঘণ্টা পর গোসল করুন, যাতে ত্বক তেলটুকু শোষণ করে নিতে পারে।
* পাকা কলা, পাকা পেঁপে, সয়াবিনের গুঁড়া অথবা ময়দা পেস্ট করে মুখে লাগান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট রাখুন। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ত্বকে টানটান ভাব আসবে।
* শীতে মুখ ধোয়ার ক্ষেত্রে সাবানের পরিবর্তে ত্বকের ধরন অনুযায়ী ক্লিনজার ব্যবহার করুন। দুধ, ময়দা ও ঘিয়ের মিশ্রণ একটি ভালো ক্লিনজার, যা আপনার ত্বককে আর্দ্রতা থেকে বাঁচাবে।
* ঠোঁট ফাটা থেকে রক্ষা পেতে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মধু এবং গ্লিসারিন একসঙ্গে মিশিয়ে ঠোঁটে লাগান।
* শীতে চুলের দরকার বিশেষ যত্ন। সপ্তাহে একদিন হট অয়েল ট্রিটমেন্ট করুন। নারকেল তেল গরম করে স্ক্যাল্পে হালকা হাতে ঘষুন। গরম পানিতে তোয়ালে ডুবিয়ে নিংড়ে নিন। তারপর তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রাখুন। সহজে তেল চুলের গোড়ায় ঢুকে যাবে। পরের দিন শ্যাম্পু করে নিন।
* আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় এ সময় খুশকি বাড়ে। খুশকি কমাতে লেবুর রস চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করতে পারেন। তেলের সঙ্গে আমলকি মিশিয়ে লাগান। বেশি কেমিক্যালসমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন না। হেনা, লেবুর রস, ডিম মিশিয়ে চুলে এক ঘণ্টা লাগিয়ে রেখে শ্যাম্পু করে নিন।
* খাবারের তালিকায় প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি এবং ফলমূল রাখুন। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
মডেল: মেহজাবীন
মেকআপ: মিউনী’স ব্রাইডাল
ছবি: মোহসিন আহমেদ কাওসা
সংগ্রহ : ইত্তেফাক.
(Visited ১ times, ১ visits today)