বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণ তার পাশে থাকলে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে কোনকিছুকেই পরোয়া করেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ষড়যন্ত্র দেখে আসছি। আমি এগুলোর পরোয়া করি না। আমি বিশ্বাস করি, যতদিন মহান আল্লাহ এবং বাংলার জনগণ আমার পাশে রয়েছেন, মা-বাবার দোয়া ও আশীর্বাদ রয়েছে, ততদিন এই লক্ষ্য অর্জনকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
তার ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বুধবার (১৭ মে) সকালে গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আাগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের পর প্রবাস জীবনে থাকতে বাধ্য হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের এই দিনে (১৭ মে) দেশে ফিরে আসেন। এর আগে তিনি ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা শেখ হাসিনার স্বামী দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানি যান। ১৫ আগস্ট তারা দুজন বেঁচে গেলেও জাতির পিতার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে সেদিন হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা দিবসটি উপলক্ষে বুধবার প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যেদিন ৩০ জুলাই আমরা দেশ ছেড়ে যাই, আমি আর রেহানা; সেসময় বিদেশে যাওয়াতো ছিল স্বপ্নের মতো ব্যাপার। কিন্তু সেবার বিদেশে যেতে যেন কিছুতেই মন টানছিল না। আমরা খুব কাঁদছিলাম। কিন্তু যেতে হলো। এই তেজগাঁও এয়ারপোর্ট হয়েই আমরা দিল্লি এবং সেখান থেকে জার্মানি যাই। কামাল, জামাল, রাসেল সবাইকে রেখে গিয়েছিলাম। কামাল-জামালের বউ সুলতানা-রোজী সবাই এসেছিল এয়ারপোর্টে। আর এই ১৭ মে যেদিন ফিরে আসি, সেদিন লাখো মানুষ, হাজার-হাজার মানুষ, সেই মানুষদের ভীড়ে আমি ৩০ জুলাই যাদের রেখে গিয়েছিলাম তাদের কাউকে পাইনি। আর বনানীতে গিয়ে পেলাম সাঁড়ি সাঁড়ি কবর। জানি না, আল্লাহ আমাকে কত শক্তি দিয়েছেন সহ্য করতে। এই দেশের জন্যইতো আমার আব্বা সারাটা জীবন এত কষ্ট করেছেন। কারাগারে যেখানে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছিলেন সেটাতো আজ উন্মুক্ত। সবাই গিয়ে দেখে আসতে পারেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) দুঃখকে কোনদিন দুঃখ, কষ্টকে কোনদিন কষ্ট মনে করেননি। বাংলাদেশের মানুষের কথাই ভেবেছেন, আমার আব্বা এবং আম্মা দুজনেই।’
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থনে বলেছেন, ‘একটাই লক্ষ্য নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলোম-এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। সেটাই যেন করতে পারি। আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, ‘আমি দুঃখিত। এত কথা যে আমাকে বলতে হবে সেটা চিন্তাও করি নাই। তবুও মনে হয় আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জানার দরকার রয়েছে। আমি যখন দেশে ফিরি সে সময় আজকের অনেকের জন্মই হয়নি। আর তখন যারা ছিলেন তাদের অনেকেও বেঁচেও নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি একটাই কথাই বলব, আমরা যারা রাজনীতি করি তারা যদি জাতির পিতার রাজনীতির দিকে তাকাই এবং তার আদর্শটা ধারণ করে রাজনীতি করি তাহলে আমরা দেশকেও কিছু দিতে পারব, দেশের মানুষকেও দিতে পারবো। মানুষ ধন-সম্পদের জন্য কতকিছু করে, কিন্তু মৃত্যু হলেতো আর কিছুই সাথে নিয়ে যেতে পারে না। সান-শওকত, বিলাসিতায় জীবন কাটালে মৃত্যুর পর অনেক কিছুই মিথ্যা হয়ে যায়। কাজেই মানুষের জন্য যদি কিছু করে যাওয়া যায়, সেটাই সব থেকে বড়ো পাওয়া। আমরা আব্বার কাছ থেকে মায়ের কাছ থেকে সেটাই শিখেছি। আর আজকে যতটুকু যাই চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেই শিক্ষা থেকেই করে যাচ্ছি।’
তিনি আরো বলেছেন, “এ দেশকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো আমার লক্ষ্য যেন আমার বাবার আত্মাটা শান্তি পায়। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট সব হারিয়েছি, সব হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় বিদেশে ছিলাম। কখনো ভাবতেও পারিনি এরকম ঘটনা আমাদের জীবনে আসবে। মাত্র ১৫ দিন আগে আমি আর রেহানা দেশে ছেড়ে বিদেশে যাই। অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। চলে আসবো কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ফিরতে পারলাম না। ’৭৫ এর কালো দিন আমাদের জীবনে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘শুধু আমরা হারিয়েছি তা তো না, বাংলাদেশের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে নিযে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; ক্ষুধা, দারিদ্র মুক্ত সমাজ গঠন, মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।’
বিদেশে ১৫ আগস্টের সংবাদ শোনার প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেছেন, ‘এ ঘটনাটা যখন আমরা শুনলাম তখন একদিকে যেমন স্বজন হারাবার বেদনা, অপর দিকে একথা বারবার মনে হচ্ছিল যে এ দেশটার জন্য সারা জীবন আমার বাবা কষ্ট করেছেন। আমরা সন্তান হিসেবে একটানা দুই বছর বাবাকে কাছে পাইনি। যে বয়সে ছেলে-মেয়ে স্কুলে যায় বাবার হাত ধরে, আমাদের সে সৌভাগ্য কখনো হয়নি। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে কারাগারে। স্কুল জীবনে কলেজ জীবনে সব সময় ঐ কারাগারে যেয়েই সাক্ষাত করতে হতো। আমার বাবা একটা জাতির জন্য, একটা দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তিনি নিজের জীবনের দিকে একবারও ফিরে তাকাননি। সব কিছু বিলীন করে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে।’
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তখন এ দেশের ৮০/৯০ ভাগ মানুষই তো দারিদ্র্যের নিচে ছিল। তারা একবেলা খাবার পেতো না, পরনে জীর্ণ কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যা আমার বাবাকে সব সময় পীড়া দিত। মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্যই তো তিনি সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী তারাও কম অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘অনেকে তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সাবধান করেছিলেন, যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। বলতেন যে ওরা তো আমার ছেলের মতো আমাকে কে মারবে।’
১৫ আগস্টের পর অপপ্রচার চালানো হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যারা দোসর ছিল, তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। যারা এ দেশের স্বাধীনতাই চায়নি, মূলত তারাই এ হত্যাকান্ড ঘটায়। আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের ভেতর থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকে আমাদের বাসায়-আসা যাওয়া করতো। ডালিম, ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালি ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসাই পড়ে থাকতো। ওঠা বসা, খাওয়া, দাওয়া সবই করতো।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, ‘মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিল। তখন কামালও ওসমানীর এডিসি ছিল। দুই জন এক সঙ্গে কর্মরত ছিল। এরা তো অত্যন্ত চেনা মুখ। কর্নেল ফারুক কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেবের শালির ছেলে। এভাবে যদি দেখি এরা কেউ দূরের না, এরাই যড়যন্ত্র করলো।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া জড়িত ছিল। জিয়ার যে পারিবারিক সমস্যা ছিল সেটা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীতে এক পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিল। তার পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান প্রায়ই, প্রতি সপ্তাহে এক বার তার স্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে ঐ ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতো। আন্তরিকতা নয়, এদের লক্ষ্য ছিল চক্রান্ত করা। সত্যি কথা বলতে কি সেটা কেউ বুঝতে পারিনি। আমরা খোলামেলা মানুষের সঙ্গে মিশতাম, সকলের জন্য অবারিত দ্বার। এ হত্যাকাণ্ডটা হয়েছে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, স্বাধীনতার যে মূল লক্ষ্য সেটা থেকে বিচ্যুত করা এবং বিজয়কে একেবারে অর্থহীন করে দেওয়ার জন্য।’
মোস্তাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘যারা এভাবে বেঈমানি করে, তারা থাকতে পারে না।.. মীর জাফরও তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মোস্তাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাথে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। এতে স্পষ্ট যে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল এবং ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল।’
জার্মানির বনে বসে ১৫ আগস্টে পরিবারের সব সদস্য নিহত হবার সংবাদ প্রাপ্তির দুর্বিসহ সময়টার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “যখন শুনলাম সহ্য করাটা কঠিন ছিলো। ১৬ তারিখে ড. কামাল হোসেন আসলেন বনে হুমায়ন রশিদ সাহেবের বাসায়। রেহানা ছোট; সে বললো, ‘চাচা আপনি মোস্তাকের মন্ত্রীত্ব নেবেন না। আপনি প্রেস কনফারেন্স করেন, আপনি এ হত্যার প্রতিবাদ করেন।’ হুমায়ন রশিদ সাহেব প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা নিলেন কিন্তু উনি কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, ‘গ্রামে-গঞ্জে যখন ঘুরেছি তখন দেখেছি সাধারণ মানুষের ভালবাসা। সে ভালবাসাই কিন্তু আমাদের আরো প্রেরণা দিয়েছে।’