একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রিভিউ শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘আমরা চাই না, বিচারটা প্রশ্নবিদ্ধ হোক।’ দণ্ডবৃদ্ধিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের আবেদনের বিষয়ে একপর্যায়ে তিনি বলেছন, ‘আমরা রায়ে বলে দিলাম এটা হবে, আমরা তো সেটা চাই না। আমরা চাই না বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হোক।’
রবিবার (১৪ মে) আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সাঈদীর রিভিউ আবেদনের ওপর প্রথম দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন-বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
এ দিন দুপুর ১২টা থেকে সোয়া একটা পর্যন্ত রিভিউ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালতে সাঈদীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আপিলে যাবজ্জীবন পাওয়া তিনটি চার্জের বিষয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন খন্দকার মাহবুব। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘এটা রিভিউ শুনানি, তাই ফ্যাক্টসে বললে হবে না; ল পয়েন্টে আর্গুমেন্ট করতে হবে।’
শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন দাবি করেছেন, প্রাসঙ্গিক ঘটনার দিন সাঈদী পিরোজপুরে নয়, যশোরে ছিলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘সাধারণত ওয়াজ হয় ধানকাটার পর শীতকালে। আর ঘটনা মে মাসে। মে মাসে তো বর্ষাকাল। আপনাকে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, ওখানে (অপরাধ সংঘটনের স্থানে) তিনি ছিলেন না।’
তিনি আরো বলেছেন, “১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তো মার্শাল ল ছিল। ’৯১-এর পর এখন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। এ সময়তো পলিটিক্যাল প্লোরালাইজেশন হয়েছে। বিয়ে-টিয়ে হয়ে অনেক আত্মীয়তাও হয়েছে।”
তখন খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর তো প্রো-লিবারেশন ফোর্স (স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি) ক্ষমতায় ছিল। তখনো তো আমার (সাঈদী) নামে কোনো মামলা হয়নি। আমিতো সাঈদী হলাম সেদিন, এসব মামলা হওয়ার পরে।’
তখন প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আপনিতো তখন সাঈদী ছিলেন না, দেলাওয়ার হোসেন শিকদার ছিলেন।’
জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘আমি শিকদার ছিলাম না। আমার সার্টিফিকেটেও সিকদার নাম ছিল না।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘সার্টিফিকেটেও কি জানি একটা ছিল শুনেছি।’
সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের পর অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে সাঈদীর রিভিউ বিষয়ে শুনতে চান আদালত। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘আমাদের আবেদন আগে শুনতে হবে তো। আমরা তো ফাঁসি চাই।’
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘একটা রায় হয়েছে। একবার দণ্ড কমার পর রিভিউতে আবার দণ্ড বাড়াটা রেয়ার (বিরল) কেস। এটা বাদ দেন। মিস্টার হোসেনেরটা নিয়ে আলোচনা করা হোক।’
তারপরও অ্যাটর্নি জেনারেল সাজা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে থাকেন।
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আইসিটি আইনের সেকশন চারটা ভাল করে পড়বেন। ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সটা ভাল করে পড়েন। আর আমি কি বললাম সেটা রাতে ভাবেন। আমরা কসাই না, যে বললেই জবাই করে দেব।’
পরে আদালত উভয় পক্ষের সম্মতিতে সোমবার (১৫ মে) পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
প্রথম দিনের শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যে সাজা তার বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছিল এই বলে যে, সে (সাঈদী) ওই সময় পিরোজপুরের পারেরহাটে ছিল না। আদালত এই বিষয়টি ঠিকমত নেননি।’
মাহবুবে আলম আরো বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষে আমরাও একটি রিভিউ ফাইল করেছিলাম। যেহেতু সে ইব্রাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তবে সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছেন, বিশাবালী হত্যাকাণ্ডে সে (সাঈদী) আদেশ দিলেও সে মুখ্য আসামি না, সে বরঞ্চ সহায়তাকারী। এই যে পর্যবেক্ষণটা, এই যে ফাইন্ডিংসটা, এটার বিরুদ্ধে আমরা সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ করেছি।’
সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছি, যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এ সাজা দেওয়া হয়েছে সেটি সঠিক হয়নি। এর পুনর্বিবেচনা দরকার। বিশেষ করে ডিসেন্ডিং জাজমেন্ট, বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা যে জাজমেন্ট দিয়েছেন, সেটিও আমরা তুলে ধরেছি। সবকিছু শুনে আপিল বিভাগ আগামীকাল (সোমবার) অ্যাটর্নি জেনারেলকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলেছেন।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের এই রায়ের পর ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রেপক্ষের আবেদনের পাঁচ দিন পর (১৭ জানুয়ারি) শাস্তি থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।