সম্প্রতি বিশ্বের অন্তত ৯৯টি দেশে বড় ধরনের সাইবার হামলার পর আবারও আলোচনা হচ্ছে হ্যাকিং ও হ্যাকারদের নিয়ে। সারাবিশ্বে বহু হ্যাকার সারাক্ষণই বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান, সরকার ও সংস্থার ওয়েবসাইট, কম্পিউটার সিস্টেম এমনকি ব্যক্তিগত কম্পিউটারও হ্যাক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই হ্যাকিং কতোটা সহজ, কেনো তারা হ্যাক করেন, কীভাবে করেন- এসব নিয়ে বিবিসি একজন হ্যাকারের সাথে কথা বলেছে। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন হ্যাকিং করা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। তার নাম পরিচয় এখানে গোপন রাখা হয়েছে।
হ্যাকিং যেভাবে শুরু
তিনি জানান, ক্লাস এইটে পড়ার সময় তার প্রথম পরিচয় হয় হ্যাকিং জগতের সাথে। তার চেয়েও কম বয়সী ছেলেরা তখন হ্যাকিং করতো বলে তিনি তখন দেখতে পান। তাদের কেউ কেউ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতেও পড়তো। পরে কম্পিউটার জগতের মাধ্যমেই অন্যান্য হ্যাকারদের সাথে ধীরে ধীরে তার পরিচয় ঘটতে শুরু করে।
হ্যাকাররা ইন্টারনেটের যে অন্ধকার জগতে ঘোরাফেরা করেন তাকে বলা হয় ডিপ ওয়েব। সেখানেই সাইবার অপরাধীদের আনাগোনা।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি পৃথিবীর এক ভাগ স্থল আর তিন ভাগ জল। সেই জলের নিচে কি আছে সেটাও কেউ জানে না। ডিপ ওয়েব সেরকমই একটি জগৎ। গুগল, আমাজন এগুলো হচ্ছে স্থলভাগের মতো। আর ডিপ ওয়েব হচ্ছে পানির নিচে গভীর অন্ধকার জগতের মতো।’
অন্ধকার জগৎ ডিপ ওয়েব
সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা এই ডিপ ওয়েবে যেতে পারে না। হ্যাকার, সাইবার ক্রিমিনাল, মাফিয়া, বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এই জগতে বিচরণ করেন। তাদের সেই দক্ষতা রয়েছে।
তিনি জানান, বিভিন্ন দেশে হ্যাকিং হচ্ছে এরকম খবরাখবর দেখে তিনি নিজেও শুরুতে হ্যাকিং করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
‘প্রথমে আমার মনে হলো দেখি তো জিনিসটা কি। তখন আমি গুগলে সার্চ করতে শুরু করি। জানতে চেষ্টা করি হ্যাকারদের ফোরাম কোথায়। এসবের কিছুটা তথ্য সেখানে পাওয়া যায়। সেখান থেকেই আমি ডিপওয়েবের সন্ধান পাই। একটি ফোরামের কথা জানতে পারি। তখন এনিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করার পর আমার চোখ কপালে উঠে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে এই রোমাঞ্চকর জগতেই আমাকে থাকতে হবে।’
তখনই তিনি শিখে যান ডিপ ওয়েবে কীভাবে লগ ইন করতে হয়, কীভাবে সার্চ করতে হয়। তখন সেখানে এক এক করে আরো অনেক হ্যাকারের সাথে তার পরিচয় ঘটতে শুরু করে। তারপর তিনি নিজে নিজেই ধীরে ধীরে সবকিছু শিখতে শুরু করেন।
কীভাবে শেখা
নিজের ঘরে ছোট্ট একটা ল্যাপটপ কোলের ওপর বসিয়ে দিনরাত কাজ করতে শুরু করেন তিনি। তখন এটা নেশার মতো হয়ে যায়। কখনো কখনো টানা তিন থেকে চারদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।
‘কেউ যখন বলে ভাই আমি হ্যাকিং শিখতে চাই সে জীবনেও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু যদি নিজের আগ্রহ থাকে তাহলে সে নিজে নিজেই আস্তে আস্তে অনেক কিছুই শিখে ফেলবে।’
তিনি দাবি করেছেন, কারো ব্যক্তিগত কম্পিউটারে তিনি কখনও আক্রমণ করেননি। যা কিছু করেছেন তার সবটাই ছিলো সাইবার যুদ্ধের অংশ।
‘অবৈধ কিছু আমি করিনি। শুধু কিছু তথ্যের জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে হয়তো তার ভেতরে ঢুকে সেখান থেকে চুপচাপ বেরিয়ে আসতাম।’
তার মতে, হ্যাকাররা আসলে খারাপ না। খারাপ হচ্ছে ক্র্যাকার।
‘যারা হ্যাকার তার হয়তো কোনো একটা ওয়েবসাইট হ্যাক করবে, সাইবার ওয়ার করবে দেশের পক্ষে। কিন্তু যারা ক্র্যাকার তারা বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে আক্রমণ করে, ক্রেডিট কার্ড থেকে তথ্য চুরি করে অর্থ সরিয়ে নেয়। ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করে।’
সাইবার যুদ্ধ
নিজে কীভাবে সাইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন জানতে চাইলে সাবেক এই হ্যাকার বলেন, ‘হঠাৎ করে আমি দেখলাম আমার দেশে একটা সাইবার আক্রমণ হলো। দেখলাম কোনো একটা ওয়েবসাইট ধসিয়ে দিয়ে সেখানে আমাদের দেশকে গালাগাল করছে। তখন আমি তার প্রতিশোধ হিসেবে একটার বদলে তাদের একশোটা ওয়েবসাইটে অ্যাটাক দিলাম।’
তিনি দাবি করেন, পাকিস্তানের সাথে যখন সাইবার যুদ্ধ হয় সে সময় তার রণকৌশল তৈরি করতেন তিনি। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আরও অনেক হ্যাকার তখন এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো।
এই হ্যাকাররা কেউ কাউকে চেনেন না, কে কোথায় থাকে জানেন না, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা আইডি আছে, সে সবের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়।
তিনি বলেন, ‘কোনো দেশের সাথে আমাদের যখন সাইবার যুদ্ধ চলে তখন আমাদের নীতি হলো আমার দেশের জন্যে আমি যেটাই করি সেটাই হালাল। আমাকে জিতে আসতে হবে। এটা হচ্ছে সোজা কথা। এর জন্যে আমাকে যতো নিচে নামতে হবে আমি নামবো। কোন অসুবিধা নেই- এটাই হলো আমাদের নীতি। অনেক সময় দেখা গেছে, আমাদের পাল্টা সাইবার আক্রমণের কারণে পাকিস্তানি হ্যাকারদের পেছনে থানা পুলিশ লেগে যেতো। তারা তাদেরকে বলতো যে তোমাদের জন্যে আমাদের দেশে সাইবার হামলা হচ্ছে। একই রকমের ঘটনা ঘটতো বাংলাদেশেও।’
সাইবার যুদ্ধের কৌশল
তিনি জানান, পাকিস্তানের সাথে সাইবার যুদ্ধের সময় তারা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করতেন। একটি গ্রুপের কাজ ছিল পাকিস্তানের ওয়েবসাইটগুলোতে আক্রমণ করা আর অন্য গ্রুপটি হ্যাকিং ঠেকাতো বা হ্যাকিং এর শিকার হলে ওই ওয়েবসাইট পুনরায় সচল করে দিতো। পাকিস্তানিরা হয়তো একশোটা ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে কিন্তু তারা দেখলো যে মাত্র কুড়িটি হ্যাক হয়েছে। তার অর্থ বাকি ৮০টি সাইট আমরা ইতোমধ্যেই সচল করে ফেলেছি। তখন তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়তো।’
তিনি জানান, পাকিস্তানে সাইবার আক্রমণের সময় তারা হিটলারের ‘ব্লিটজ ক্রিগ’ কৌশল অনুসরণ করতেন। পাকিস্তান ছাড়া তিনি ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ভারতের সাথেও সাইবার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
তিনি জানান, ইউরোপ অ্যামেরিকার সরকারি নিরাপদ ওয়েবসাইটগুলোতে তারা ঢুকেছিলেন। বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেন ইসরায়েলি ওয়েবসাইট হ্যাক করার কথা।
‘ইসরায়েলে একটি ওয়েবসাইট হ্যাক হলেই সেটা আন্তর্জাতিক খবর হয়। কারণ দেশটির সাইবার নিরাপত্তা খুবই কঠোর। কিন্তু এমন দিন গেছে যে আমরা একদিনেই ৪০ থেকে ৫০টি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছি।’
তিনি জানান, সারা বিশ্বে হ্যাকারদের এরকম কয়েক হাজার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।