রাজধানীতে রবিবার (১৬ এপ্রিল) থেকে বন্ধ করা হয়েছে গণপরিবহনে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস। বিষয়টি গাড়িচালক ও মালিকরা ঠিকমতো মানছেন কিনা এবং গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা তা দেখতে নগরীর পাঁচটি জায়গায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ’র (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশকিছু মামলাও হয়েছে। সকাল থেকেই রাত পযন্ত রাস্তায় গণপরিবহনের সংকটের কারণে বিপাকে পড়েন কর্মজীবীরা। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন কর্মজীবী নারীরা।
রাজধানীতে যে সকল স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে সেগুলো হলো- আসাদগেট, আগারগাঁও, বিমানবন্দর রোড, যাত্রাবাড়ী ও আইইবির সামনে। সকালে সাত রাস্তার মোড় এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, সবাই নিয়মের মধ্যে এলে কোনও সমস্যাই হবে না। যাত্রীদের ভোগান্তি রোধেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষের ভোগান্তি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করব।
মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী এক যাত্রী তামরিন জানান, নিউভিশন নামের মতিঝিল-মিরপুর রুটের বাসগুলো মিরপুর থেকে কাওরানবাজার, এরপর কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রত্যেকবার নতুন করে নির্দিষ্ট ভাড়া রাখে। বাংলামোটর নামলেও কাওরানবাজার থেকে মতিঝিলের ভাড়া দিতে হয়। এরা ভাড়ার নামে নৈরাজ্য করছেই। ভাড়ার তালিকাও বাসে লাগানো হয় নি।
আরেক যাত্রী কনা আক্তার জানান, সিটিং সার্ভিসের মান বাড়োনোর জরুরি, বন্ধ করা নয়। বাসের ধরন হওয়া উচিত পয়েন্ট টু পয়েন্ট, স্টপেজ ভিত্তিক। সিটের অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া উচিত নয়। গণপরিবহনকে মানসম্মত করতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। যানজটের এই শহরে অফিসে সময়ে বেশিরভাগ স্থানে স্টপেজ নিয়ে বাস থেমে থেমে গেলে কতটা সময় নষ্ট হবে, সেটা বিবেচনা জরুরি।
সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলা বাসগুলো নতুন নিয়মের তোয়াক্কা না করে আগের মতোই ভাড়া আদায় করছে যাত্রীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। পুরান ঢাকা থেকে বাড্ডার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া আলিম খান জানান, সু-প্রভাত স্পেশাল নামে একটি বাস সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া আদায় করছে। মিরপুর রোডের বিহঙ্গ ও ইউনাইটেডের কিছু কিছু বাসে এ ধরণের প্রতারণা চলছে। এ কারণে যাত্রীদের সঙ্গে চালক ও হেলপারদের বাক-বিতণ্ডা করতে দেখা গেছে।
এ ছাড়াও ওয়েলকাম, লাব্বাইক, স্বজন, ইন্টারসিটি, নিউভিশন, তানজিল, মিরপুর মিশন, বসুমতি, পরিস্থান, দিশারী, বিকল্প, শিকড়, ল্যামস, বিহঙ্গ, এভারেস্ট, নিউভিশন, আশীর্বাদসহ অধিকাংশ বাসই নিয়মের তোয়াক্কা না করে সিটিং সার্ভিস হিসেবে আগের মতো চলাচল করছে। আবার দেখা যায়, সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে জাবালে নূর, আকিক পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস। মতিঝিল, যাত্রাবাড়ি, মিরপুর-১০, রামপুরা ব্রিজ, মহাখালীসহ বেশ কয়েকটি রুটের বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
সড়ক পরিবহন সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৫ এপ্রিলের পর যাত্রীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া যাবে না। ভাড়ার তালিকা বাসের ভেতর দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। ছাদের উপরে ক্যারিয়ার, সাইট অ্যাঙ্গেল ও ভেতরের অতিরিক্ত আসন খুলে ফেলতে হবে। প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আসন সংরক্ষণ করতে হবে। এক মাসের মধ্যে রঙচটা, রঙবিহীন, জরাজীর্ণ বাস মেরামত করে রাস্তায় নামাতে হবে।
মোটরযান আইন অনুসারে, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। চালকের আসনসহ মিনিবাসে ৩১টি আসন থাকবে। এর বেশি আসন হলে তা বাস। আর বিআরটিএ পরিবহন খাতের ২০টি বিষয়ে ব্যয়ের খাত বিশ্লেষণ করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। সর্বশেষ ব্যয় বিশ্লেষণে প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ৮০ শতাংশ আসন পূর্ণ হয়ে চলাচল করবে।
চাকরিজীবি অভি মন্ডল জানান, পুরান ঢাকা থেকে বাসে এসেছি অনেক ধাক্কা-ধাক্কি করে। উত্তরার অফিস থেকে বের হয়েছি সন্ধ্যার সময়। কিন্তু আসার সময় একটি বাসেও উঠতে পারি নি। হাতে গোনা যে কয়টি বাস গেছে তার সবকয়টিতে উপচে পড়া যাত্রী ছিল। এখন ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোন রকমে ফার্মগেটে এসেছিলাম গাড়ির আসায়। কিন্তু এখানেও দেখি পরিবহন সংকট। সকালে যে এসেছি তখন লোকাল সার্ভিস বললেও রেখেছে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া।
কাকরাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) এর সামনে থাকা বিআরটিএ-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত-২ বেশ কিছু সিটিং সার্ভিস ও গেটলক বাস আটক করেন। বাসগুলোকে আটক করে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর জরিমানা ও মামলা করা হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ৩৯ ও ৪০ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণ করায় মামলা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ীও গাড়ির ফিটনেস, ব্লুবুক, ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক না থাকায় এবং বাম্পার ও অ্যাঙ্গেল থাকার কারণে মামলা হয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকায় কোনো সিটিং সার্ভিস অথবা গেটলক বা বিরতিহীন বলতে কিছু থাকবে না। ভাড়া আদায় হবে বিআরটিএ-এর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী। রবিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত-২ এর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম এ সব কথা জানান।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এক বিবৃতিতে জানান, যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে যাত্রীদের দীর্ঘদিনের দুর্দশা, হয়রানি ও ভাড়ার নৈরাজ্য লাঘব হবে। যাত্রীসেবার মান বাড়বে, মাঝপথের যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনার অবসান হবে। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলায় বড় বাসের (ব সিরিজ) ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের (জ সিরিজ) ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা। বড় বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া তিন কিলোমিটার পর্যন্ত সাত টাকা, মিনি বাসের তিন কিলোমিটার পর্যন্ত সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা।
বিবৃতিতে এই হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী ভাড়া প্রদানে জন্য যাত্রী সাধারণকে অনুরোধ জানানো হয়। ভাড়ার তালিকা পাওয়া না গেলে বিআরটিএ ওয়েবসাইটে অথবা যাত্রী কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ফোন করে নিজ নিজ রুটের ভাড়ার তালিকা সংগ্রহ করার অনুরোধ জানানো হয়। ফোন নম্বর- ৯৫৬৮৩৯৯।