ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ১৭ এপ্রিল সোমবার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করে। পরে এই বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়।
এর আাগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তনী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ দিন ঘোষিত ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।
ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও তাজউদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
অপরদিকে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দিনের ভাষণের মধ্যদিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণের এই সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে এই দিনটির তাৎপর্য ছিল বিশাল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পরে ১১ এপ্রিল স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাজউদ্দিন আহমদ একটি বেতার ভাষন দেন। এ ভাষনে তিনি দেশব্যাপি পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। এছাড়াও ১৭ এপ্রিল মন্ত্রী সভার শপথ গ্রহনের তারিখ নির্ধারিত হয়।
আর সেই অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত করেছিলেন ১৭ বছরের এক কিশোর মো. বাকের আলী। যিনি কয়েক বছর আগে কলেজ শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। সেদিন কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে তিনি এই দায়িত্বটি পালন করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন বাসস’কে।
বাকের আলী তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশ আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিহারী অধ্যুষিত দর্শনায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ১৬ এপ্রিল বিকেলে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে আসেন।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথ তলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিসের সভা, কি উদ্দেশ্যে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা। সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পায়ে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার স্কুল শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন স্যার সেখানে ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে এ অনুষ্ঠানে কুরআন পাঠ করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে বাকের আলীর শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন বলেন, ‘বাকের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুললিত কন্ঠে কোরান তেলোয়াত করতো। এ ছাড়াও সে ছিল ধর্মভীরু। তাই শপথগ্রহন অনুষ্ঠানে তাকেই টেনে নিয়েছিলাম।’
মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো; আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ পৃথক বাণী দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দিবসটি পালনে মেহেরপুরের মুজিবনগর ও রাজধানী ঢাকায় দিনব্যাপি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আগামী কাল সোমবার সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচী শুরু করা হবে।
সকাল ৯টায় মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, বিএনসিসি, স্কাউট ও স্কুলের শিক্ষার্থীগণ কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ ও গার্ড অব অনার প্রদর্শন করবে।
সকাল সাড়ে ১০টায় মুজিবনগর শেখ হাসিনা মঞ্চে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়াও একই স্থানে বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে দেশবরেণ্য শিল্পীদের নানা পরিবেশনা থাকবে।
দবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।রাজধানী ঢাকা এবং মেহেরপুর ও মুজিবনগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ বিশেষ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। সেই সাথে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে বিকেলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যথাযোগ্য মর্যাদায় মুজিবনগর দিবস পালন করবে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামীকাল ভোর ৬ টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও কেন্দ্রীয় এবং দেশের সকল জেলা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭ টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ।
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সূত্র: বাসস