নিশি অবসান প্রায়/ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত!/আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন/ করিলাম নত/ বন্ধু হও শত্রু হও/যেখানে যে কেহ রও/ক্ষমা করো আজিকার মতো/পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।’
নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বিদায় নিয়েছে বঙ্গাব্দ ‘১৪২৩’। শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ, বাংলা সন ১৪২৪-এর প্রথম দিন। শুভ নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের ঐতিহ্যের নিজস্বতায় ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠা একমাত্র সার্বজনীন উৎসব। গ্রামীণ কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখ এখন শহরের আঙ্গিনায় আলোকিত প্রাণের উৎসব। গ্রাম থেকে শহরে আনন্দ মুখর পরিবেশ ও নানান অনুষ্ঠানে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন বাংলা বছর।
সম্প্রতি নানা ঘটনার পর জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন ছড়িয়ে আছে চারপাশে। তাই এবারের নববর্ষে মুক্তপ্রাণের আশাবাদ- প্রগতি ও অসাম্প্রদায়িকতার পথ ধরে এগিয়ে যাক দেশ।
পাওয়া না পাওয়ার পার্থক্যই হচ্ছে মানুষের জীবন। অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতা ও ভুলের সমারোহে পাওয়ার হিসাব বেশির ভাগ মানুষেরই মেলে না। কিন্তু সমৃদ্ধির স্বপ্ন, না পাওয়াকে পাওয়ার আশা জীবনের চাকা এগিয়ে নেয়। আর ব্যর্থতার হতাশায় দাঁড়িয়ে স্বপ্ন ও আশার এ সুতোটি বেঁধে দেয় সময়, নতুন একটি বছর।
উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশিদের আবেগের তীব্রতায় জাতি সত্ত্বার প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতি হিসেবে ‘আমিত্ত্ব’র খোঁজ পাওয়া একমাত্র উৎসব যেন এই পহেলা বৈশাখ।
নববর্ষকে স্বাগত জানাতে শুক্রবার তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরবেন। ছেলেরা পরবেন পাজামা ও পাঞ্জাবি। নগরের পথে পথে দেখা মিলবে এ তরুণ-তরুণীদের।
দেশে বর্ষবরণের মূল অনুষ্ঠান হবে রাজধানীর রমনার বটমূলে। পহেলা বৈশাখের ভোরে ছায়ানটের উদ্যোগে বটমূলে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’-গানের মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেওয়া হয়। পহেলা বৈশাখ রাজধানীর সব পথ যেন গিয়ে মিশবে রমনার বটমূলের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান স্থলে। নানা অনুষঙ্গে উৎসব মুখরতা ছড়িয়ে পড়বে পুরো দেশময়।
২০০১ সালে এখানেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন। তবে তা থামাতে পারেনি বাঙালির প্রাণের উৎসবকে। প্রতিটি বাংলা বছরের প্রথম দিনে এখানেই তাই ফিরে ফিরে আসে বৈশাখের উৎসব।
এখন বাংলা নববর্ষের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। গত বছরের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে হওয়া এ শোভাযাত্রা। সেই হিসেবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকছে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলার পর মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য- ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।’
শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়ে থাকে।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর এবার পহেলা বৈশাখে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হবে বলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিনে ভাল রান্না হবে ঘরে ঘরে। একে অপরকে মিষ্টি মুখ করাবেন। শিশুরা লাল-সাদার মিশেলে বৈশাখী পোশাকে ঘুরে বেড়াবে। একদিন আগে শুরু হলেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ে চলবে শুক্রবার সারাদিন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন নববর্ষের উৎসবের রঙে রঙিন।
শহরের নববর্ষের সকালবেলা পানতা-ইলিশ খাওয়া একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। এটাকে ঘিরে অনৈতিক ব্যবসাও পাখা মেলেছে। নববর্ষের আগে ইলিশ হয়ে হয়ে যায় যেন ‘সোনার হরিণ’। কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হয় ইলিশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এবার নববর্ষের দিন ইলিশ খাওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিছু দিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ মেলায়, এবারের বর্ষবরণে উৎসব নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মূল ভেন্যু রমনা বটমূল, শহীদ মিনার এলাকা, টিএসসি এবং চারুকলাসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আগেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছে, সন্ধ্যার পর খোলা স্থানে বর্ষবরণের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাঝখানে অংশ নেওয়া যাবে না, নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভুভুজেলা। রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কে নিয়ন্ত্রিত থাকবে যান চলাচল। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে মোটরসাইকেল চালকরা স্ত্রী-সন্তান ব্যতীত অন্য কাউকে আরোহী হিসেবে নিতে পারবেন না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এত বিধি-নিষেধ বর্ষবরণের আনন্দকে কিছুটা ম্লান করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।যদিও নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করার মতো নয় মোটেও।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষে পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এজন্য নতুন-পুরাতন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন, পুরনো হিসাব চুকিয়ে নিতেন। আগের মতো না হলেও এখনও আছে হালখাতা। যেমন গ্রামে, তেমন শহরে। পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখনও নববর্ষে হালখাতা করে থাকেন।
নববর্ষের উৎসব মুখরতায় ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে বৈশাখী মেলা। এখনও গ্রামে-গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মেলা শুরু হচ্ছে শুক্রবার থেকে।
বৈশাখী মেলায় মিলবে কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং মুড়ি, খৈ, বাতাসা, নানা ধরণের মিষ্টিসহ বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় এসব মেলায়। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে।
ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী কনসার্ট হবে। অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতে নববর্ষে পান্তা-ইলিশসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হবে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও সকল উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।
পহেলা বৈশাখে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে বলে সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে।