বাংলাদেশ ভাটির দেশ (ডাউন স্ট্রিমিং)। তাই এই দেশে নদীতে পানি আসবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। এমন মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে তিনি তিনি বলেছেন, ‘বর্ষাকালে আসা পানি নদী খনন করে ধরে রাখার ব্যবস্থা করলে সেই পানির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।’
ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করতে মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ডাউনস্ট্রিমে (ভাটি অঞ্চল), সুতরাং পানি আসবেই। কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’
তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবায় ভারত যখন বাঁধ দিয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ সরকারেরও একটা বক্তব্য থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘গজলডোবার বাঁধ যখন করা হয়, তখন যারা ক্ষমতা্য় ছিল তারা কিন্তু এ ব্যারেজ নিয়ে কথা বলে নাই। আজকে যারা চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, তারাও বলেনি। আমাদের পক্ষ থেকেও ভুল করা হলো। সেখানে (তিস্তায়) একটি সরকার ব্যারেজ বানালো। যার ফলাফলটা আমরা ভোগ করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেক সরকার এসেছে। অন্যরা কেউ তিস্তার পানি নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি।’
তিস্তা নদীর পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জি (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী) ঢাকায় এসে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন পানি দেবেন। এবারও তিনি ফিজিবিলিটি স্টাডির (সম্ভাব্যতা যাচাই) কথা বলেছেন। মোদি (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) স্পষ্ট বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকতেই পানি চুক্তি হবে। যেহেতু কথা দিয়েছেন, এজন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। আর শুধু পানি দাও, পানি দাও না বলে, পানি ধরে রাখার নিজস্ব পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের।’
পানি না পেলেও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বিদ্যুত দিতে রাজি হয়েছেন। তাই পানি না পেলেও একেবারে খালি হাতে ফিরতে হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি পানি চেয়েছিলাম, মমতা বিদ্যুৎ দিয়ে দিয়েছেন। বিদ্যুৎটা তো পেলাম। খালি হাতে তো ফিরিনি।’
বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেওয়ার বিষয়ে মমতা ব্যানার্জির বিকল্প প্রস্তাব প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিকল্প নদীর যে কথা বলেছেন, ওখানে আমিও বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। ওইসব নদী থেকে তিস্তায় পানি নিয়ে, তিস্তা থেকে পানি দিতে বলেছি। তিনি (মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, এ ব্যাপারে স্টাডি করবেন।’
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে রাজবাড়ী জেলার পাংশায় যে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল সে বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে যখন গঙ্গার পানি চুক্তি করি, তখনই আমি বলেছিলাম, আমরা একটা ব্যারেজ করব, গঙ্গা ব্যারেজ। সেই ব্যারেজটা হবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে এবং যৌথভাবে। এমনভাবে এটা তৈরি করা হবে যেন দুটি দেশের মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারে।’
তবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ভুল ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় গঙ্গা ব্যারেজ নামে যে ব্যারেজের সমীক্ষা ও যে ডিজাইনইনটা তৈরি করেছে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা আমি নাকচ করে দিয়েছি। কারণ এটা আমাদর জন্য আরও আত্মঘাতী হবে, ওই তিস্তা ব্যারেজের মতো আত্মঘাতী হবে।’
এ ধরনের পরিকল্পনা যারা করেছে তাদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কিছু মানুষের চিন্তা থাকে, একটা বানানো গেলেই টাকা আসবে পয়সা আসবে, কমিশন আসবে…।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক নিয়েও। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যেখানে আমি আছি সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিছু হবে না, আমি বেঁচে থাকতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু হবে না। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অনেকে জীবন দিয়েছেন; তাদের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে এত প্রশ্ন কেন, এটাই আমার প্রশ্ন। স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে চুক্তি হতে পারে আর যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন, জীবন দিয়েছেন, তাদের সাথে হলে এত প্রশ্ন আসছে কেন।’
শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকে ফলপ্রসূ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘সফরটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। সম্পূর্ণ তৃপ্তি আছে। তৃপ্তিতে কোনো সন্দেহ নেই। যে কোনো কাজ আমি করি, তা ভেবেচিন্তে করি, সিদ্ধান্ত নেই। হতাশ হবার কিছু নেই। হতাশ হবার মতো কোনো কিছু ঘটেনি।’
এ সফরে ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারত সরকার ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নমনীয় ঋণের ঘোষণা প্রদান করে। এ অর্থ দিয়ে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়াও সামরিক খাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার নমনীয় ঋণ প্রদান করবে ভারত। আমরা যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’- এর হিন্দী সংস্করণের মোড়কও উন্মোচন করেছি।’’
ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে তা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ সফরে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে মোট ৩৫টি দলিল স্বাক্ষরিত হয়। এগুলোর মধ্যে ১১টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক ২৪টি। বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত ৯ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি চুক্তি এবং এম.ও.ইউ এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।’
তিনি বলেছেন, ‘‘দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভারতের গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ দিল্লীস্থ ‘পার্ক স্ট্রীট’-এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রোড’।’’
সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন করা বিভিন্ন সার্ভিসের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি, প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী যৌথভাবে খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রিবাহী রেল ও বাস চলাচল এবং বিরল (দিনাজপুর-রাধিকাপুর (ভারত) রুটে পণ্যবাহী রেল চলাচলের উদ্বোধন করেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।