কাজল সরকার, হবিগঞ্জ : হাওড়ে কান্নার রোল। কাঁদছে হাওড়ের মানুষ। চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে সোনার ফসল। একমুঠো ফসলও ঘরে তোলার সম্ভাবনা নেই। প্রতিদিন পানি বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় নির্বাক মানুষ। এমনিতেই গোটা বছরই হাওড় থাকে পানির নিচে। জানুয়ারির দিকে একটু শুকায়। আর এতেই জন্মে বোরো ফসল। এই বোরো ফসলের ওপরেই নির্ভরশীল কোটি মানুষ।
১০ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমির ফসল বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। কুশিয়ারা, কালনী, রত্না ও খোয়াই নদীর বাঁধ উপচে হাওড়ে পানি প্রবেশ করায় এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বানের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আজমিরীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মঙ্গলবার রাত ও বুধবারের ভারি বর্ষণে বৃহস্পতিবারে কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ৩ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমির ফসল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে লাখাই উপজেলায় ১ হাজার ৪২৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৬৪০, আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৭৫৫ হেক্টর, নবীগঞ্জে ৬২০, বাহুবলে ৭৫ ও চুনারুঘাটে ৭০ হেক্টর জমির ফসল বানের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়।
বুধবার জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি আগাম বানের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অনেক স্থানে নদীর পানি আটকাতে স্বেচ্ছায় বাঁধ মেরামতে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষকরা। ছোট ছাট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে নারীরাও বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। তাদের চোখ জুড়ে এখন শুধু অমাবশ্যার অন্ধকার। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন তারা। তাদের দাবি- একটি বাঁধ নির্মাণ।
তারা বলছেন, হাওড়ের পাহাড়ি ঢল থেকে ফসল রক্ষা করতে প্রতিবছরই সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাওড়ের বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দ এলেও অদৃশ্য কালোহাতের ছায়া পড়ে। ফলে আর বাঁধ নির্মাণ করা হয় না।
লাখাইর বুল্লা বাজারের আফরোজ মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের একটি হাওড় সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত পানি বাড়ার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলা দিয়ে বানের পানি এসে আমাদের জমিগুলো গ্রাস করছে। এমন অবস্থায় আমরা কি করব বুঝতে পারছি না।’
আব্দুল আলী নামে এক কৃষক জানান, ‘এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ ধানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সবাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এখন ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করানো দূরের কথা সারাবছর তাদের মুখে কি তুলে দেব বুঝতে পারছি না।’
বানিয়াচঙ্গের মাকালকান্দি গ্রামের কৃষক মধু মিয়া বলেন, ‘গ্রামের সকল মানুষ নেমেছিলাম হাওড়ের চারপাশের বাঁধ দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাঁধ দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। নিজেদের চোখের সামনে তলিয়ে গেল আধাপাকা ধান।’
পাহাড়পুরের কৃষক অর্জুন দাস বলেন, ‘অন্যবছর বৈশাখের শেষ দিকে পানি আসে। ফলে আমরা কোনরকমে ধানগুলো নৌকা দিয়ে কেটে আনতে পারি। কিন্তু এ বছর কাঁচা ও আধাপাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এগুলো কি করব।’
বরগা চাষী মনমোহন দাস বলেন, ‘মহাজনের কাছ থেকে ঋণ এনে কয়েক বিগা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। কিন্তু পানির নিচে সব ফসল তলিয়ে যাওয়ায় মৃত্যু ছাড়া পথ দেখছি না। কি করে মহাজনের ঋণ শোধ করব। আর কি খেয়ে সারাবছর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেঁচে থাকব, তা বুঝতে পারছি না। এমন অবস্থায় ভিটে মাটি বিক্রি ছাড়া কোন পথ নেই।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, ‘বানিয়াচং উপজেলার মাহতাবপুরে খোয়াই নদীর বাঁধ ভেঙে হাওড়ে পানি প্রবেশ করায় প্লাবিত হচ্ছে। লাখাইয়ে পানি আসছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের মেঘনা নদীর বাঁধ উপচে ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হাওড় প্লাবিত হচ্ছে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ উপচে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এমএল সৈকত জানান, ‘কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া বসিরা নদীর খাল দিয়েও পানি আসছে।’