র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র্যাব) গোয়েন্দা শাখার সদ্য প্রয়াত প্রধান লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন তার সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তার স্মরণে খোলা ফেসবুক পেজে সকলে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন, স্মরণ করছেন।
সিলেটের মৌলভীবাজারে জঙ্গি বিরোধী অভিযানকালে গত ২৫ মার্চ (শনিবার) বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছিলেন লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। সেই রাতেই সিলেটে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে মধ্যরাতেই তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার সিএমএইচে আনা হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নততর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে আবুল কালাম আজাদকে ২৯ মার্চ রাতে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সিএমএইচ হাসপাতালে তাকে পুনরায় ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। শুক্রবার বিকেলে তাকে বনানীর ঢাকা সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুতে শোকাহত র্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যরা। শোকাহত আজাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচিতরাও।
গত বুধবার লে. কর্ণেল আজাদের সুস্থতা কামনা করে ফেসবুকে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ। তিনি লিখেছিলেন, ‘র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. ক. একে আজাদ অসাধারণ সাহসী বীর ও দেশপ্রেমিক। সে দেশের জন্য নিবেদিত, দায়িত্বে অনুগত একজন পরিপূর্ণ পেশাদার অফিসার। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি তিনি একজন ফ্যামিলি ম্যান ছিলেন। পরিবার-পরিজন, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের কাছে পছন্দের পাত্র আজাদ এখন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন। সিলেটের জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। দেশের এ বীর সন্তানের সুস্থতা কামনায় আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইছি।’ বেনজীর আহমেদের মতো দেশের আর সবাই নিঃসন্দেহে লে. কর্ণেল আজাদের সুস্থতায় দোয়া করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে যেতে হলো এই বীর মানুষটিকে।
এ সহযোদ্ধার মৃত্যুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলাম শুক্রবার এক শোক বার্তায় বলেছেন, ‘২৫ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৭ টায় সিলেটের পাঠানপাড়া শিববাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ এক নৃশংস ও বীভৎস ঘটনার জন্ম দেয়। এ সময় উপস্থিত জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দায়িত্বে নিয়োজিত অবস্থায় বোমার আঘাতে গুরুত্বর আহত র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ ৩১ মার্চ রাত ১২টা ৫মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। একই ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় দুই মেধাবী কর্মকর্তা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোর্ট ইন্সপেক্টর চৌধুরী মো. আবু কয়ছর এবং জালালাবাদ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম শাহাদাৎ বরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘এ তিন সাহসী কর্মকর্তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে এটিই পুনরায় প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য বদ্ধপরিকর। আমরা দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করি এবং নিশ্চয়তা দিতে চাই যে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গিবাদের স্থান হবে না, যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করা হবে।
’
পরে নিজের ফেসবুক ওয়ালে শুক্রবার (৩১ মার্চ) সকালে এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন— ‘সকলকে কাঁদিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চিরবিদায় নিলেন প্রিয় সহযোদ্ধা লে. কর্নেল আজাদ! সহযোদ্ধার মৃত্যু বেদনা দেয় এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে মানবকুলে সৃষ্ট দানব ধ্বংসে আমাদেরকে আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ করে! আজাদ, আপনাকে ফিরে পাবো না জানি কিন্তু কথা দিচ্ছি আপনার হত্যাকারীদের রক্ষা নাই, সমূলে তাদের বিনাশ অনিবার্য করে তুলবোই! আপনার স্মৃতি বুকে ধারণ করেই অসুর দমনে এগিয়ে যাচ্ছি, যাবো!!!
’
এইচএম দেলোয়ার জাহান নামে লে. কর্ণেল আজাদের এক সহকর্মী ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের জুন মাসের কোনো এক বিকেল বেলায় র্যাব সদরের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের মিডিয়া উইং এ ডিশ লাইনের সংযোগ দিচ্ছিল। স্যার দূর থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করছ এখানে। বললাম, এখানে ডিশের সংযোগ দিচ্ছে তো তাই আমি দেখছি। স্যার এর হালকা গোলাপি কালার শার্ট পড়া ছিল ইন করা। স্যার তখন আছর নামাজ পড়ে ছাদে দাঁড়িয়ে। স্যার খুব আন্তরিকভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি সেদিন বুঝতেই পারিনি স্যার ইন্ট. উইং এর পরিচালক। আমিও তখন র্যাবে নতুন। যাক, কিছুদিন পর চিনতে পারলাম। স্যারের চলাফেরা এমন ছিল যে উনি অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের। ২০১৬ সালে মিরপুর পুলিশ কনভেনশন হলে স্যারের হাসিমাখা কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়েছিলাম। স্যার সম্ভবত সে বছর পিপিএম পেয়েছিলেন। স্যার এভাবে চলে যাবেন আমরা তা কল্পনাও করিনি। আল্লাহ্ আপনাকে বেহেশতবাসী করুক, আমিন।’
পারভেজ নাদির রেজা লিখেছেন, ‘ভাই, জান্নাত থেকে এই জাতির জন্য দোয়া করবেন, যাতে এই হায়নাদের হাত থেকে দেশ মুক্ত হয়।’
সহকর্মী শেখ রাসেল লিখেছেন, ‘জীবন দিয়ে যারা করে গেল ঋণ, তোমাদের আমরা ভুলিনি, ভুলিনি, বিনম্র শ্রদ্ধা।’
তৌহিদুল মান্নান নামের একজন লিখেছেন, ‘R.I.P Great Soldier…মহান মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই আপনারাও মহান শহীদ…দেশের শান্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপনাদের এই ত্যাগ জাতি বিনম্র চিত্তে আজীবন স্মরণ করবে।’
আব্দুল্লাহ মাহমুদ লিখেছেন, ‘দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে গিয়ে অকালে চলে গেলেন বাংলা মায়ের অকুতোভয় সৈনিক র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে.কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। দেশ একজন কৃতি মেধাবী ও সাহসী সন্তানকে হারালো। তোমাকে স্যালুট হে বঙ্গবীর।’
১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের মনকষা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লে. কর্ণেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ৭ জুন ৩৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদী কোর্সে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। কমিশন পরবর্তী তিনি ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আইও, অ্যাডজুটেন্ট এবং কোয়ার্টারমাস্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেনাসদর, প্রশাসনিক শাখায়, ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন এবং ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন কমান্ডো। ২০০৫ সালে তিনি সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে প্যারাট্রুপারে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্যারা কমান্ডো হিসেবে উত্তীর্ণ হন।
২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি র্যাব-১২ এর কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একই বছর ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত র্যাব ফোর্সেস সদর দফতরে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (টিএফআই সেল) উপ-পরিচালক এবং ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে এই উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘ ৫ বছর ৪ মাস র্যাবে কর্মরত থেকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, দক্ষতা, আন্তরিকতা, সুনামের সাথে পালন করেছেন লে. কর্ণেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম-সেবা) এবং প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পুরস্কারে ভূষিত হন। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বিশেষ করে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও হিযবুত তাহরিরের সদস্যদের গ্রেফতারের ব্যাপারে লে. কর্নেল আজাদের অবদান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক।