এউয়ন মরগ্যানের ছিলেন বেন স্টোকস, একটু পেছনে ফিরে গেলে মাইকেল ক্লার্ক পেয়েছিলেন মিচেল স্টার্ককে। তারও চার বছর আগে মাহেন্দ্র সিং ধোনির ট্রামকার্ড ছিলেন যুবরাজ সিং।
ভিন্ন সময়, আলাদা দেশ, পৃথক খেলোয়াড়— কত তফাৎ। তাতে কী? ক্রিকেট-ঈশ্বরের অদৃশ্য ইশারায় সব যে মিলেমিশে একাকার! অধিনায়কদের হয়ে তারাই তো জিতেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়ে অক্ষয় কালিতে লিখেছিলেন নিজেদের নাম।
কালের গহ্বরে অলক্ষ্যে তৈরি হয় আশ্চর্য এক আলোর সেতু। ইতিহাসের অবাক পুনরাবৃত্তিতে রচিত হয় অর্জনের নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাসে কি এবার বাংলাদেশের পেস আক্রমণের কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেদের জড়িয়ে নেবেন?
ইতিহাস ঘুরে ফিরে নতুন নায়ক খুঁজে নেয়। ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের পোস্টারবয় হয়ে উঠা তাসকিন আহমেদ কি পারবেন সেই নায়কদের একজন হতে। অনেক ঘাম ঝরিয়ে আনন্দাশ্রু পাওয়া ডানহাতি দ্রুতগতির বোলার নিশ্চয়ই আলো কেড়ে নেওয়ার মতোই সামর্থ্যবান।
শুধু-ই কী তাসকিন! তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পেস ব্রিগেডের যে কেউই তো অধরা সাফল্যে ভাসাতে পারেন। হাসান মাহমুদ, মোস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলামরা তো এখন ভরসার আয়না। চতুষ্টয়ের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই একটি নাম যুক্ত হয়ে যেত, ইবাদত হোসেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় ছুরি কাঁচির নিচে গিয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিটকে গেছেন বিশ্ব আসর থেকে।
বড্ড বাড়াবাড়ি নয়, অতিরঞ্জিতও নয়, বাংলাদেশের এই পেস আক্রমণ এখন বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে তুলনীয়। পরিসংখ্যান তো তা-ই বলছে।
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর পেস বোলিং গড় (২০১৯ বিশ্বকাপের পর)
দল | ম্যাচ | গড় | উইকেট | ইকোনমি |
বাংলাদেশ | ৫৩ | ২৮.৪২ | ৩৮৭ | ৫.০০ |
শ্রীলঙ্কা | ৫৬ | ৩১.১১ | ৩৯৮ | ৫.৩৫ |
পাকিস্তান | ৩৬ | ৩১.১৪ | ২৮৫ | ৫.৪৬ |
ভারত | ৬৬ | ৩১.১৭ | ৪৭২ | ৫.৫৬ |
আফগানিস্তান | ২৯ | ৩২.২৬ | ১৯৬ | ৪.৯২ |
নিউ জিল্যান্ড | ৪৩ | ৩২.৬১ | ৩০৯ | ৫.৪১ |
দ. আফ্রিকা | ৪০ | ৩২.৯৭ | ২৮৩ | ৫.৬৮ |
অস্ট্রেলিয়া | ৪৪ | ৩২.৯৮ | ৩২৪ | ৫.৩৮ |
ইংল্যান্ড | ৪২ | ৩২.৯৮ | ২৯২ | ৫.৪৩ |
নেদারল্যান্ডস | ৩৪ | ৪০.২১ | ২০৭ | ৫.৪১ |
২২ গজে সোনালী দিন কাটানো এই পেসারদের অগ্রদূত সুদর্শন তাসকিন। নিজেকে ভেঙে গড়ে তোলা এই পেসার ২০১৯ বিশ্বকাপে নিজের নাম দেখতে না পেরে চোখের জলে ভাসিয়েছিলেন মিরপুরের আঙিনা। সেই আঙিনায় আজ তার নামে রব উঠে। ওই ধাক্কায় পাল্টে যায় তার জীবনের গতিপথ। তার পায়ের নিজের জমিন শক্ত হয়েছে অজস্র ঘাম ঝরিয়ে। বাড়িয়েছেন গতি। হয়েছেন নিয়ন্ত্রিত, ক্ষুরধার।
জিমে চলতে থাকে কসরত। তীব্র রোদ আর উত্তপ্ত সময়ের সঙ্গেই করে নেন মিতালি। তার ঘামে সিক্ত হয় বালুচর। পিছু না ছাড়া চোট-আঘাত থেকে মুক্তি পেতে আর শরীরকে পোক্ত করতে নিজেকে প্রস্তুত করেন কঠিন ফিটনেস ট্রেনিংয়ে। মনোবিদের কাছে নিতে থাকেন মাইন্ড ট্রেনিং কোচিং স্টাফদের সঙ্গে স্কিল ঝালাই। কত পথ পেরিয়ে, কত ঘাম ঝরিয়ে, কত বাধা মাড়িয়ে, দীর্ঘশ্বাসের অনেক প্রহর পেরিয়ে ঝলমলে হাসির দিনের দেখা পেয়েছেন। এখন সবুজ গালিচায় তার চোখের কোণে চিকচিক করে আনন্দাশ্রু!
বড় স্বপ্ন নিয়ে ক্যারিয়ার লম্বা করছেন তাসকিন, ‘আমাদের স্বপ্ন আমরা বিশ্বের শীর্ষ দল হব, সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী আমরা ক্রিকেট খেলছি এবং এগোচ্ছি। আস্তে আস্তে মাঠেও দৃশ্যমান হচ্ছে। যদি এইভাবে ধারাবাহিকতা থাকে, সামনে অনেক বড় বড় ইভেন্ট আছে, ওসবেও প্রতিফলন পড়বে।’
নিজেদের স্বপ্নের সীমানা পেরিয়ে যেতে চান এ পেসার, ‘এখনও আমাদের পরের ধাপে যাওয়া বাকি। আমি মনে করি আমরা সঠিক পথে আছি। মানসিকতা ভালো। যদি এই প্রক্রিয়ায় থাকি, আমাদের এই স্বপ্নও পূরণ হবে যে; আমরা সবাই বিশ্বমানের হব।’
বাংলাদেশের আফসোসের বড় জায়গাজুড়ে রয়েছেন ইবাদত হোসেন। মাত্র ১২ ওয়ানডে খেলা ইবাদতের ক্যারিয়ার আগাচ্ছিল দারুণভাবে। ১১ ইনিংসে বল করে ২২ উইকেট নিয়েছেন তিনি। তার অভিষেকের পর এই সংস্করণে দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট তার। ইনিংসের মধ্যভাগে প্রতিপক্ষের হুমকি হয়ে ছিলেন। কিন্তু বড় মঞ্চে যাওয়ার আগে অস্ত্রোপচার করানোয় তাকে ছিটকে যেতে হয়েছে। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের কণ্ঠে ইবাদতে হারানোর হাহাকার প্রকাশ পেয়েছে, ‘দুর্ভাগ্য যে ইবাদত আমাদের দলের অংশ হতে পারছে না। ও আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।’
২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। ২০ উইকেট নিয়ে ছড়িয়েছিলেন মুগ্ধতা। কিন্তু তাসকিন, ইবাদত, শরিফুলদের ধারাবাহিক উন্নতিতে মোস্তাফিজ পিছিয়ে পড়েন। সীমিত সামর্থ্য, অনুকূলে থাকা উইকেটের সুবিধা নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারেননি এ সময়ে। খোলসে আটকে থাকায় দল থেকে বাদ পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। পিছিয়ে পড়ে আবার ফিরেও এসেছেন এই বাঁহাতি। কিন্তু প্রত্যাশার পারদ ছুঁতে পারেননি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শরিফুল-হাসানরা নিজেদের জায়গা পোক্ত করেছেন।
তারুণ্যের প্রতীক হয়ে আসা হাসান মাহমুদ ও শরিফুল ইসলাম হচ্ছেন ‘চেরি অন দ্য টপ’। শুধু বোলিংয়ে তারা মুগ্ধ করছেন না। নিজেদের পরিপক্বতা, কথার সৌন্দর্য, ভাবনার গভীরতা, প্রতিপক্ষকে মূল্যায়ন, নিজেদের যত্ন, কাজের পরিধি নির্ণয়, আগ্রাসী মনোভাব, হারার আগে না হারার মানসিকতায় অনন্য হয়ে উঠেছেন। শরিফুল যুব বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়। শিরোপা কীভাবে জিততে হয় তার সবটাই জানা। হাসান মাহমুদ এই আক্রমণে এনেছেন পূর্ণতা, এসেছেন সামর্থ্যরে জানান দিয়ে। সঙ্গে প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছেন।
তাদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদও, ‘আমাদের ইন্টারেস্টিং পেস বোলিং আছে। বিশ্বেই মনে হয় দ্বিতীয় স্ট্যাট বেজে। শুধু আমাদের এক্সপোজ করতে হবে নিজদের। ওই ফ্রিডম নিয়ে খেলতে হবে। আমি চাই, ছেলেরা ওভাবে ফাইট করুক মাঠে। আমি মনে করি আমাদের হারানোরও কিছু নাই, চাপেরও না। আমরা যদি ওই মন-মানসিকতা নিয়ে খেলতে পারি, যদি এক্সপোজ করতে পারি ঠিক মতো… চাপ আসবে, কিন্তু আমি প্রেশারটা ওভাবে বলছি ফ্রিডম নিয়ে খেলতে হবে। তাহলে আমাদের সাফল্য আমাদের কাছে আসবে অবশ্যই।’
নির্ভরতার প্রতীক হয়ে বড় মঞ্চে নিজেদের কারিশমা দেখিয়ে যাচ্ছেন এই পেস বিগ্রেডরা। সাফল্যের হাসির পর আবার ব্যর্থতা ঝেঁকে বসবে। সেজন্যও তারা প্রস্তুত আছেন। তবে এই চক্র থেকে কীভাবে উন্নতি করা যায়, সেই পথ চেনা হয়ে গেছে তাদের। এজন্য সামনের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতেও ভয় নেই তারুণ্যের অভিযাত্রীদের।
ক্রিকেটের গালিচায় লড়াইয়ের ময়দানে এক্সপ্রেস গতি আর ঝাঁঝালো বাউন্সার হাতে ছুটবেন এই বিগ্রেডের সৈনিকেরা। বুকে বাঘের সাহস নিয়ে নিশ্চয়ই হুংকার দেবেন আরেকবার। যে হুংকার কেঁপে উঠবে গোটা বিশ্ব। ভাগ্যপ্রসূত হলে সাকিব-বিগ্রেডের এই সৈনিকেরা হতে পারেন শিরোপার সূর্যস্নানে ভাসিয়ে নেওয়ার ফেরিওয়ালা।