পাঁচ বছর আগে স্বামীর কাছে স্কুটি চালানো শিখে যাতায়াতের ভোগান্তি কমিয়েছেন অহিদা পাপড়ি। স্কুটি ব্যবহার করে সন্তানদের স্কুলে আনা নেওয়াসহ নানা কাজ সারেন; কমেছে খরচও। নিজে সুবিধা পাওয়ায় অন্য নারীদের অনুপ্রাণিত করতে ‘লেডি বাইকার’ নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন তিনি। অনেক নারী এখন সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
পেশায় শিক্ষিকা পাপড়ি পটুয়াখালী শহরের থানাপাড়া এলাকার ফরহাদ হোসেন খানের স্ত্রী। পটুয়াখালী সদর উপজেলার চর জৈনকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ শিক্ষক নারীদের স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে সাড়া ফেলেছেন। এ কাজের জন্য টাকাও নেন বেশ ‘অল্প’।
প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার পরে শহরের ঝাউবন এলাকায় পাপড়ি স্কুটি চালানো শেখান। সারাদিন ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীদের সামলে ‘ক্লান্ত’ পাপাড়ি প্রশিক্ষণের কাজটিও করেন বেশ মনযোগ দিয়েই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন অহিদা পাপড়ি। শেখানোর জন্য তার দুটি স্কুটি রয়েছে; নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করেন বিভিন্ন সরঞ্জাম। স্কুলে চাকরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বাড়তি আয় হচ্ছে তার।
শুরুর গল্পটা জানতে চাইলে পাপড়ি বলেন, আমার বাসা থেকে স্কুল অনেক দূর। সেখানে আমাকে রিকশা নিয়ে যেতে হয়। আবার মাঝে মাঝে আমার সন্তাদেরও স্কুলে নামিয়ে দিতে হয়। এসব ঝামেলার কথা চিন্তা করে নিজেই স্কুটি চালানোর উদ্যোগ নেই। পরে আমার স্বামী আমাকে প্রশিক্ষণ দেন। সেও শিক্ষকতা করেন। দুজনেই ব্যস্ত থাকায় দুজনের সুবিধার্থে এই স্কুটি প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি সহজে চলাচল করছি।
পাঁচ বছরে যেহেতু আমার সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে, তাই অন্য নারীদেরকেও সুবিধা দিতে স্কুটি শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ অনেক মেয়েরাই চায় মোটরসাইকেল বা স্কুটি চালাতে। কিন্তু ভালো প্রশিক্ষকের অভাবে তা হয়ে ওঠে না।
তিনি আরও জানান, পটুয়াখালীতে অনেক নারীই আছেন যারা, মহিলাদের কাছে শিখতে চান। এ চিন্তা থেকে ফেইসবুকে ‘লেডি বাইকার পটুয়াখালী’ নামে একটি পেইজ খুলে আগ্রহীদের যোগাযোগ করার আহ্বান জানান। এ জন্য খুবই সামান্য পরিমাণ রেজিস্টেশন ফি নেন স্কুটির জ্বালানি ও মেরামতের খরচ চালাতে।
শুক্র ও শনিবার স্কুল ছুটি থাকলেও পাপড়ির প্রশিক্ষণে কেন্দ্র খোলা থাকে। এই দুদিন দিনের বেলা পটুয়াখালী খেলার মাঠ ও কৃষি বিমান অবতরণ কেন্দ্র (এয়ারপোর্ট) এলাকায় ক্লাশ নেন তিনি।
সপ্তাহের বাকিদিনগুলো যেহেতু দিনেরবেলা নিজের পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই রাতের বেলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন এ লেডি বাইকার। তিনি জানান, দেখা যায়, অনেক কর্মজীবী নারীরা রাতের বেলাই প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
স্কুটি শিখে জীবন অনেকটা সহজ হয়েছে মন্তব্য করে পাপড়ি বলেন, এখন নিজের স্কুলে যাওয়ার পথে সন্তাদের নিজেই স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান। আবার স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের নিয়েই আসেন বাসায়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া বা কেনাকাটা করতে সন্তানদের নিয়ে একাই স্কুটি চালিয়ে চলে যান।
চাকুরীজীবী, আইনজীবী ও গৃহিনীসহ বিভিন্ন পেশার নারীদের স্কুটি চালানো শিখেছেন পাপড়ি। বর্তমানে চারজন তার কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যারা শিখে গেছেন, তাদের বেশীর ভাগই স্কুটি কিনে নিয়েছেন বলে জানান এ শিক্ষিকা।
মির্জাগঞ্জের বাসিন্দা আইনজীবী আয়শা সিদ্দিকা স্কুটি চালানো শিখেছেন পাপড়ির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তিনি বলেন, আমি পটুয়াখালীতে কোর্ট করতাম। সেখানে আসা-যাওয়া করতে বেশ বিড়ম্বনায় পরতে হতো। অটোরিকশা, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল অথবা মাহিন্দ্রায় যেতে হতো। গণপরিবহনে চলতে গেলে নানা রকম অসুবিধায় পড়তে হয়।
পরে জানতে পারি, পটুয়াখালীতে একটি লেডি বাইকার নামে এক পাপড়ি আপা স্কুটি প্রশিক্ষণ দেয়। তাই সিদ্ধান্ত নেই তার কাছে প্রশিক্ষণ নেব। মাত্র সাতদিনেই আমি চালানোর কায়দা রপ্ত করে ফেলি। এখন স্কুটিও কিনেছি। চলাফেরায় এখন আর ঝামেলা পোহাতে হয়না।
প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী জাকিয়া সুলতানা বলেন, আমি একটি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করি। সকালে বচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আমার কর্মস্থলে যাই। প্রতিদিন আমার আসা-যাওয়ায় প্রায় একশ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। আবার রিকশায় চলাফেরা করলে অনেক সময় লেগে যায়। এই সুবিধার কথা চিন্তা করেই আমি স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি এখন মোটামুটি ভাবে স্কুটি নিয়ে চলাচল করতে পারি। বর্তমানে আমার সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়।
বরিশাল বিএম কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী উম্মে কুলসুম জানান, পটুয়াখালীর বাসা থেকে বরিশাল কলেজে যাতায়াতে নানা ঝামেলা পোহাতে হতো তাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাপড়ির কথা জেনে স্কুটি চালানোর ক্লাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তিনদিনের মধ্যেই তা রপ্ত করে ফেলেন।
আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুটি কিনে বরিশাল কলেজে আসা-যাওয়া করতে পারব। বলেন কুলসুম।
পাপড়ির প্রংশসা করে মনি নামের এক নারী বলেন, লেডি বাইকার প্রশিক্ষক পাপড়ি আপা খুব ভাল, তার আচার-ব্যবহারও খুব। আমার মাধ্যমে আমার ফ্রেন্ডরা অনেকেই প্রশিক্ষণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কলাপাড়া উপজেলার গৃহিনী জেসমিন বেগম সোনিয়া বলেন, মেয়েদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার দরকার আছে। স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণটা নিয়েছি। আমার কাছে এখন খুবই ভালো লাগছে আমি নিজেই স্কুটি কিনবো।
পাপড়ির এ উদ্যেগে বিপুল সাড়া মিলেছে বলে জানালেন তার স্বামী ফরহাদ হোসেন খান। তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী স্কুটি চালানোর ফলে তার প্রতিদিনের যে যাতায়াত খরচ সেটা সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়াও আমার বাচ্চাদেরকে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে যে ধকলটা যেত সেটাও কমেচে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার পরে নারীদের শেখার বিষয়ে বেশ সাড়া পাচ্ছি।