১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ওই সময় রণাঙ্গনে লড়াইয়ের পাশাপাশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বহির্বিশ্বে বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে জনমত ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়। আর এ কাজটি করতে যারা অসীম সাহসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাদের একজন ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিনগত রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এর মধ্য দিয়ে একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। মুহিতের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল তার স্বজন, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ। শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন মহল।
জানা যায়, ১৯৫৬ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক কাউন্সিলরের দায়িত্বে ছিলেন মুহিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেন মুহিত। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি ও সমর্থন আদায়ে নেমে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করে সমর্থন আদায় করতে থাকেন।
ওই সময়ের ভূমিকার জন্য গর্ববোধের কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন মুহিত। তিনি বলে গেছেন, সেই ভূমিকা রাখতে পারা তার জন্য সৌভাগ্যের ছিল।
মুহিত ১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের নেতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজের দ্বিতীয় ছেলে মুহিত। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মুহিতের ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে উচ্চশিক্ষা নেন মুহিত। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর তখনকার পাকিস্তান এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা সচিবের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব হন মুহিত। ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে ‘অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে’ কাজ শুরু করেন ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও আইএফএডি-তে।
১৯৮২-৮৩ সালে তখনকার এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে প্রথমবারের মতো অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন মুহিত। দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার পর দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি পান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার কাঁধেই রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট ১২ বার ও টানা ১০ বার বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করার রেকর্ড গড়েন মুহিত।
মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনীতি নিয়ে ৩০টির অধিক বই লিখেছেন মুহিত। জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুহিতকে ২০১৬ সালের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করে সরকার।