বারাক ওবামা ঘোষিত স্বাস্থ্যসুরক্ষা আইন বাতিল করে নতুন স্বাস্থ্যসুরক্ষা আইন চালু করতে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর এ নিয়ে তার প্রশাসনে অস্থিরতা চলছে। উদ্যোগটি ব্যর্থ হওয়ার জন্য একে অপরকে দায়ী করছেন। কে ভুল ছিল, আর কে ঠিক ছিল তা নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। কেবল তাই নয়, খোদ ট্রাম্পই নিজের প্রশাসনের কর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। কারও কারও অভিযোগ, প্রশাসনের অভ্যন্তরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা ট্রাম্পেরই সৃষ্টি। ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন সহযোগীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরের সেই কোন্দলকে সামনে নিয়ে এসেছে।
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণের পরই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘ওবামাকেয়ার’ বাতিল করে নতুন স্বাস্থ্যনীতি চালু করার তৎপরতা শুরু করেন ট্রাম্প। ‘ওবামাকেয়ার’-এ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনে ‘আমেরিকান হেলথ কেয়ার অ্যাক্ট’- নামের স্বাস্থ্য বিল উত্থাপন করে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও বাধার মুখে পড়েন ট্রাম্প। গত শুক্রবার প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়ায় কংগ্রেস থেকে নতুন স্বাস্থ্যনীতি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন ট্রাম্প। হাউস স্পিকার পল রায়ান জানান, স্বাস্থ্যনীতি পাসের জন্য কংগ্রেসে ২১৫ ভোটের প্রয়োজন হয়। কংগ্রেস সদস্যরা এতে সমর্থন দেননি, তাই তিনি এবং ট্রাম্প বিলটি প্রত্যাহার করে নিতে সম্মত হয়েছেন।
ট্রাম্পের অনেক সহযোগী মনে করেন, প্রশাসনের ভেতর যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা প্রেসিডেন্টের নিজেরই তৈরি। যখন ট্রাম্পের স্বাস্থ্যসুরক্ষাজনিত পরিকল্পনাটি জটিলতায় পড়লো তখন এর জন্য অন্যকে দায়ী করার পথ খুঁজে নিলেন ট্রাম্প। কখনও ডেমোক্র্যাটদের ওপর আবার কখনও সে দায় নিজের প্রশাসনের কর্মীদের ওপরও দিচ্ছেন তিনি।
চলতি মাসে হোয়াইট হাউসের অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা গ্যারি কোহন ‘ফক্স নিউজ সানডে’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। স্বাস্থ্যসুরক্ষা নীতি ব্যর্থ হওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধেও নাকি চটেছেন ট্রাম্প। এ ব্যাপারে জানাশোনা রয়েছে এমন তিন ব্যক্তির বরাত দিয়ে পলিটিকো এমন তথ্য জানিয়েছে। ট্রাম্প মনে করেন, গ্যারি পরিকল্পনাটি ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। অবশ্য হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র হোপ হিকস এ তথ্য অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, ট্রাম্প ‘গ্যারির উপস্থাপনের ব্যাপারে প্রশংসাসূচক ছিলেন’।
ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষোভের মুখে হাউস স্পিকার পল রায়ানও রয়েছেন বলে মনে করেন কেউ কেউ। হোয়াইট হাউস ও হাউস স্পিকার শিবিরের মধ্যেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার রায়ানের সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে ফোনে কথা বলেছেন ট্রাম্প। সকালে ট্রাম্প টুইটারের মাধ্যম জনগণকে রাত নয়টায় ফক্স নিউজে জাজ জেনিন শোটি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
নিউ ইয়র্কের সাবেক বিচারপতি, প্রসিকিউটর, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এবং রিপাবলিকান নেতা জেনিন ফেরিস পিরো রাত নয়টায় তার অনুষ্ঠান শুরু করেন। শো-এর শুরুতেই জেনিন বলেন, ‘হাউস স্পিকার হিসেবে পল রায়ানের পদত্যাগ করা প্রয়োজন।….তিনি ভোট সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
কেউ কেউ ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের দিকেও অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, এ স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিল পাসের উদ্যোগ ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কুশনার। সম্প্রতি এক বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য কুশনার যখন ওবামাকেয়ার নীতির স্থপতি ইজেকিয়েল ইমানুয়েলকে আমন্ত্রণ জানালেন তখন সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। আর ট্রাম্পের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নীতিটি যখন টলটলায়মান অবস্থায় আছে তখন কুশনার দুইদিনের জন্য আসপেনে স্কি ট্রিপে চলে যান।
প্রসঙ্গত, ওবামার স্বাস্থ্যনীতি অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের মার্কিন জনগণ, কর্মজীবী ও বেকার উভয়েই ওই স্বাস্থ্যসেবার আওতাভুক্ত ছিলেন। ওবামা প্রশাসনের সময়কার স্বাস্থ্যবিলে অঙ্গরাজ্যগুলো কর্মজীবী ও কাজ খুঁজতে থাকা মার্কিন জনগণের জন্যই স্বাস্থ্যসেবার আবেদন করতে পারতো। তবে অঙ্গরাজ্যগুলো স্বাস্থ্যসেবা পেতে কাজের বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে রাজি হয়নি। বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান গভর্নর কর্মক্ষম জনগণ, যাদের শিশু সন্তান নেই, অথবা নিঃসন্তান, তাদের জন্য কাজ করার বাধ্যবাধকতা আরোপের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলোকে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। ট্রাম্পের ওই প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতিতে অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়।
কংগ্রেসে স্বাস্থ্যবিলটি পাস করাতে ব্যর্থ হওয়ার পর রবিবার সকালে একটি টুইট করেন ট্রাম্প। সেখানে ট্রাম্প লিখেছেন: ‘ডেমোক্র্যাটরা ডিসিতে হাসছেন এই ভেবে যে, ক্লাব ফর গ্রোথ ও হেরিটেজের সহায়তা নিয়ে প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ও ওবামাকেয়ারকে বাঁচিয়েছে ফ্রিডম ককাস।’
ট্রাম্প মনে করেন, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ক্লাব ফর গ্রোথ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং হেরিটেজ অ্যাকশন ফর আমেরিকার মতো কনজারভেটিভ গোষ্ঠীগুলো ফ্রিডম ককাসের সদস্যদের ওপর প্রভাব তৈরি করেছে। ফ্রিডম ককাস হলো কংগ্রেসনাল ককাস। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের রিপাবলিকান সদস্যদের নিয়ে ফ্রিডম ককাস গঠিত।
অবশ্য ফ্রিডম ককাসের সাবেক সদস্য এবং ট্রাম্পের ব্যবস্থাপনা ও বাজেটবিষয়ক কার্যালয়ের পরিচালক মিক মুলভ্যানি স্পিকারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে যাওয়ার খবর অস্বীকার করেছেন। এনবিসির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে মুলভ্যানি বলেন, ‘আমি কখনও তাকে (ট্রাম্প) রায়ানকে দোষ দিতে দেখিনি। যেসব মানুষ হ্যাঁ ভোট দেয়নি তাদেরকেই দায়ী করা প্রয়োজন।’
ট্রাম্প প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিলটি পাস করাতে কাজ করেছিলেন মুলভ্যানি। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম ৬৫ দিনে ওয়াশিংটনকে বদলাতে সক্ষম হতে পারিনি। আমি ফ্রিডম ককাসকে চিনি। এটি গড়ে তুলতে আমি আমি সহযোগিতা করেছিলাম। আমি কখনও ভাবিনি এটি এ পর্যায়ে আসবে।
এদিকে ডেডলাইন অনুযায়ী বিলটি পাস করাতে না পারায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাবেক রিপাবলিকান স্পিকার নিউট গিংগ্রিচ। ফক্স নিউজ সানডে অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ও রায়ানকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘ব্যর্থ হওয়ার জন্য কৃত্রিম ডেডলাইন নির্ধারণ করবেন না’।