‘হ্যাঁ, আমি একজন ওয়েডিং ফটোগ্রাফার’- প্রীত রেজা!
২০০০-২০০২
ফটোগ্রাফির ভূত মাথা থেকে নামছে না! গত দুই বছর কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ‘চঞ্চল মাহমুদ ফটোগ্রাফি’র সাইনবোর্ডে লেখা ‘ফটোগ্রাফি শিখুন’ শব্দটা প্রিয় থেকে অপ্রিয় হয়ে উঠছিল। খবরও নিয়েছিলাম কত টাকা লাগবে একটা কোর্স করতে। কিন্তু ‘ফিল্ম ক্যামেরা’ কেনার চ্যালেঞ্জটা নিতে পারিনি। ক্যামেরা কিংবা কোর্স ফি কোনটাই, বাবার পকেট মারলেও হবেনা- এটা ভেবে হতাশ হতাম, নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে…”দেখিস একদিন আমারও………!”
২০০৩
“৫০০ টাকায় ফটোগ্রাফি শিখুন!”- ঢাকা ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউটের এই বিজ্ঞাপন আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। “ক্যামেরা না থাকলেও চলবে”- টিএসসি’র ফোন বুথে ফোনের ঐ প্রান্তের মহিলার বলা এই বাক্যটি নিঃসন্দেহে আমার জীবনে শোনা মধুরতম বাক্য! ক্যামেরা ছাড়া ফটোগ্রাফি শেখার ব্যবস্থা করার জন্য ঢাকা ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট বা ডিপিআই-এর বাদল ভাইয়ের কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
২০০৪
নিজের অল্প কিছু জমানো টাকা, বোনের বৃত্তির টাকা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার শর্তের কথা লিখিত দিয়ে বাবার কাছ থেকে পাওয়া কিছু টাকা, আর কিছু হাওলাত নেওয়া বন্ধুর কাছ থেকে- সবমিলিয়ে সাহস করে একটা ‘ফোর্থ হ্যান্ড’ ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনেই ফেললাম এলিফেন্ট রোডের বাদল ভাইয়ের কাছ থেকে। এরপর “এখানে ২০ টাকায় ছবি তোলা হয়।”- ভাল করে ফটোগ্রাফি শেখার আগেই প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হয়ে গেলাম! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসবে ছাত্রছাত্রীদের পোর্ট্রেট তুলে দিতাম, প্রতি ছবি ২০ টাকা, 4R প্রিন্টসহ। হলের মেয়েরাই বেশি ছবি তুলত।
২০০৪-২০০৫
২০০৪-এর শেষের দিকে কিংবা ২০০৫-এর প্রথমে, ঠিক মনে নেই, রোকেয়া হলের এক ছাত্রী জানাল, আমার তোলা ছবি (ঐ যে ২০ টাকায় 4R প্রিন্টসহ) তার পছন্দ হয়েছে এবং আমি তার বিয়েতে ছবি তুলবো কিনা? আমি এক কথায় রাজি! বলে দিলাম, ৬০০ টাকা প্রতি রোল, মিনিমাম দুই রোলের কন্ট্রাক্ট হল। এ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে বাদল ভাইয়ের কাছে ছুটলাম ফ্ল্যাশ ধার নেওয়ার জন্য।
জাপান কালার ল্যাবে ফিল্ম ডেভেলপ করার সুবাদে তখনকার সব বাঘা বাঘা ওয়েডিং ফটোগ্রাফারদের দেখা পেতাম। যারা ইভেন্টের পর দিন ছবি ডেভেলপ করাতে এসে একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করত, “কি ভাই, কয়টা জবাই দিলেন?” উত্তর, “আরে বইলেন না, বেশি না, ৩০টা! আসবে এই ২০টার মত।” আরেকজন বলল, “কপাল আপনাদের, আমাদেরটা বাজেট বেশি ছিল না, মোট ৫টা।” – পশু জবাইয়ের কথা হচ্ছিল না, হচ্ছিল ফিল্ম জবাইয়ের কথা। ওই আলাপগুলো আমার বেশ লাগত। মনের অজান্তেই ল্যাবের ওই আড্ডাটা আমাকে ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহী করে তোলে ধীরে ধীরে।
শুভ্র ভাই তখন ডাকসাইটে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। ল্যাবের সিড়িতে সাহস করে একদিন বলে ফেললাম, “আপনার সাথে আমাকে একটা ইভেন্টে নিবেন?” বাকিদের মত এটা সেটা না বুঝিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন! সেদিনের সেই ‘হ্যাঁ’-এর জন্য স্যালুট আপনাকে শুভ্র ভাই।
২০০৬
ক্যামেরার লোন একটু একটু করে শোধ হচ্ছে, আর আমার ফটোগ্রাফি করার আসল ইচ্ছেটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনের কোণে। আমি আসলে ফটোসাংবাদিক হতে চাই। পত্রিকায় ছবির নীচে গোটা গোটা অক্ষরে আমার নাম থাকবে, “ছবিঃ প্রীত রেজা”। ঘুম থেকে উঠে নিজের নামসহ ছবি দেখবো পত্রিকায়, এটাই স্বপ্ন ছিল।
তৎকালীন ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকার লাইফস্টাইল পেজের বিভাগীয় সম্পাদক শাহান কবন্ধের সাথে পরিচয় হয় কোন এক আড্ডায়, আমার প্রিয় বন্ধু জয় শাহরিয়ার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। শাহানকে আমার ইচ্ছার কথা জানাই। আমার আগ্রহ দেখে একটা এ্যাসাইনমেন্ট দিল ও, থিম ‘ইভ টিজিং’, পত্রিকার জন্য আমার প্রথম কাজ। মোটামুটি হয়েছিল ছবি। সেই থেকে শুরু। এরপর রানা ভাইয়ের হাত ধরে ‘ভোরের কাগজ’-এ প্রদায়ক আলোকচিত্রী হিসাবে কিছুদিন কাজ করলাম। তারপর ‘সংবাদ’, ‘দ্যা ডেইলি স্টার’-এর ‘স্টার ক্যাম্পাস’-এ, ‘আনন্দ আলো’ ম্যাগাজিনে কাজ শুরু করলাম। আহ, কি উত্তেজনা, স্পৃহা ছিল সেসব দিনগুলোতে!
২০০৭-২০০৮
‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ ফিচার বিভাগে ফটো সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করলাম। এটাই আমার প্রথম ফুলটাইম চাকরি। দিনে ২৪ ঘন্টার ১৭-১৮ ঘন্টা আমি কাজ করতাম। দিনে অফিসে হাজিরা দেওয়া, পত্রিকার এ্যাসাইনমেন্ট করা, আর রাতে পাঠশালায় ফটোগ্রাফি শেখা। এরপর ‘দৃক নিউজ’-এ অল্প কিছুদিন কাজ করে দৈনিক ‘নিউ এইজ’-এ দুই বছর ফটো সাংবাদিকতা করি।
২০০৯-২০১০
পত্রিকার কাজের পাশাপাশি ওয়েডিং ফটোগ্রাফিও করা শুরু করি সে সময়, শুধু মাত্র অর্থের জন্য! পত্রিকার চাকরি সন্মানের, নামধাম হচ্ছিল কিন্তু উপার্জন মনমতো হচ্ছিল না। এদিকে খরচের চাপ বাড়ছিল ক্রমশ। যে কয়টা ওয়েডিং ইভেন্ট কভার করতাম মাসে মন দিয়ে ভাল কিছু করার চেষ্টা করতাম। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম, হাসিখুশি মানুষের চেহারার ছবি, কান্নারত কনের ছবি, মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনের গল্প তৈরি করতে ভালোই লাগছে।
আমি ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হতে চাইনি সেভাবে কখনোই। তবে ভাল উপার্জনের পাশাপাশি বর-কনের উষ্ণ ভালোবাসা আমাকে মোহিত করত! কিন্তু হঠাৎ যেন এক অদ্ভুত সত্য আবিষ্কার করলাম- আমি যেই গত কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রতি আমার আগ্রহের কথা জানান দিচ্ছি, ঠিক সেই সময়টাতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছিলাম সব জায়গাতেই। উদাহরণ দেই; পত্রিকার অফিসে আমাকে এক উদ্ভট কারণ দেখিয়ে ‘শোকজ’ করা হয়েছিল। আমি যা করি তা নাকি লো প্রেস্টিজিয়াস জব, পত্রিকার চাকরির ভারিক্কির সাথে তা ঠিক যায় না। কত শুনেছি, “আপনি এতো ভাল ছবি বুঝেন, বিয়ার ছবি তুলেন কেন?” পাঠশালায় আমার অনেক সহপাঠী আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আমি বলার চেষ্টা করতাম, “আমি ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হতে চাই।” অথচ সব ছাত্ররাই অবশ্য কমবেশি ‘বিয়ের ছবি’ তুলতো কিন্তু এটা বলতে লজ্জা পেত বা এটাকে মূল পেশা হিসাবে চিন্তা করতো না। তাতে দোষের কিছু নেই হয়তো। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক বন্ধুরাও আমাকে নিয়ে লজ্জা পেত, কারণ আমি বিয়ের ছবি তুলি এবং এটা আমার পেশা। এমনকি, পারিবারিকভাবেও আত্মীয়স্বজন যে-ই চমকে উঠত। বলত, “কি বল? অর্থনীতির ছাত্র হয়ে বিসিএস না দিয়ে ছবি তুলবে? তাও ‘বিয়ের ছবি’?”
হ্যাঁ মন খারাপ হত, হতাশাও ছিল, কিন্তু আমার মধ্যে আর বেশি কাজ করত এক্সাইটমেন্ট, ক্যামেরার চোখে বর-কনের স্বপ্ন বন্দি করার সেই উত্তেজনার কাছে আর সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে যায়!
একসময় জিদ চেপে বসল। অন্যের তৈরি করে দেওয়া মসৃণ পথে হাঁটলে হয়তো এতোটা চ্যালেঞ্জিং আর ইন্টারেস্টিং হতোনা আমার ক্যারিয়ারটা, বরং আনকোরা এক পথে হেঁটেছি বলেই বোধহয় বিজয়ের আনন্দটাও বেশিই ছিল সবসময়।
চ্যালেঞ্জ ছিল আর একটা। আমি যেই বাধা বিপত্তিগুলোর সম্মুখীন হয়েছি সেগুলো থেকে পরের প্রজন্মকে মুক্তি দেওয়ার চ্যালেঞ্জ, পেশাটিকে একটা সন্মানজনক জায়গায় নিতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলাম। উঠে পড়ে লাগলাম। বাংলাদেশের প্রথম ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনের আয়োজন করলাম আমার প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েডিং ডায়েরি’র ব্যানারে। কোন স্পন্সর পাইনি। দৃক থেকে অনুমতি পেলাম গ্যালারি ব্যবহারের জন্য, সাথে পেলাম (প্রয়াত) তারেক মাসুদকে, কি যে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল সেদিন নিজেকে!
ঐ যে সবাই বলে যে, কষ্ট করলে কেষ্ট মিলবে। সেই সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন এতো চড়াই উতরাই পেরিয়ে যেন প্রাপ্তির শুরু! ২০১৩ সালে ‘নিউ এইজ’-এর পক্ষ থেকে ইয়াং আইকন ২০১২ পুরষ্কার পাই। ২০১৩ সালে ফুজিফিল্ম আমাকে অ্যাম্বাসাডর হিসাবে স্বীকৃতি দিল। বাংলাদেশের কোন আলোকচিত্রী এই প্রথম ফুজিফিল্মের অ্যাম্বাসাডর হল। একই বছর বাংলাদেশে আলোকচিত্রভিত্তিক প্রথম লাইভ টিভি টক শো ‘ডার্করুম’ উপস্থাপনা শুর করি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজে। মুন্নী সাহাকে বিশেষ ধন্যবাদ এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এরপর ২০১৪তে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার এবং উদ্যোক্তা হিসাবে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপ পাই।
এরপর কি মনে করে যেন নিজের জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক দেখলাম একবার মনে মনেই! ক্যামেরা ছাড়া ফটোগ্রাফি শেখা, ২০ টাকায় ছবি তোলা, এর ওর থেকে টাকা ধার নেওয়া, ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে প্রবেশ, ফটো সাংবাদিকতা, শোকজ, পদে পদে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, এরপর আর ফিরে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে চলা, দেশের প্রথম ওয়েডিং এক্সিবিশন, প্রথম লাইভ টিভি টক শো, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপ…..জীবনটা কিন্তু দারুন এক্সাইটমেন্টেই কাটল। আমার মনে হয় এবার অন্যদের সুযোগ করে দেওয়ার পালা। তার মানে কিন্তু এই না যে আমি রিটায়ার করছি (হাহা!)। বরং, আমি চাই পরের প্রজন্মের জন্য পথটা আরেকটু সহজ করে দিতে। আমি যে খুব শখ করে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি শুরু করি তা নয়। আবার আমার পথটাও কাঁটায় ভরা ছিল। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৫ সালে ‘ওয়েডিং এন্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস অফ বাংলাদেশ’ (ডাব্লিউপিপিবি)-এর পরিকল্পনা করি সমমনা ওয়েডিং ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে নিয়ে।
এই পথচলাতেও সকলের সহযোগিতা পেয়েছি তা নয়। তবে স্বপ্নটা যখন বড় এবং অনেকে মিলে দেখা, এটিকে সত্যি করার দায়িত্বটা কাধে নিয়েছি নিঃস্বার্থভাবেই। বাংলাদেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি পথ অতিক্রম করে এসেছে বহুদূর, এবার কেবল এগিয়ে যাওয়ার পালা। আর এই এগিয়ে যাওয়ার পথটাকে আরেকটু মসৃণ করাই ‘ওয়েডিং এন্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস অফ বাংলাদেশ’ (ডাব্লিউপিপিবি)-এর মূল লক্ষ্য। আশা করি সবাইকে পাশে পাবো আমরা।
লেখক
প্রেসিডেন্ট
‘ওয়েডিং এন্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস অফ বাংলাদেশ’ (ডাব্লিউপিপিবি) WPPB
সিইও
ওয়েডিং ডায়েরি Wedding Diary Bangladesh
** published in WPPB annual magazine 2016
cartoon: one & only TANMOY