‘খোকা’। বাবা শেখ লুৎফর রহমান। মা সায়েরা খাতুন। গ্রামের অন্য দশটা শিশুর মতই জন্ম ‘একটি টিনের ঘরে’। দিনটি ছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায়। বনেদী শেখ পরিবারে লুৎফর-সায়েরা দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রসন্তানের মধ্যে ‘খোকা’ ছিলেন তৃতীয়। সবার আদরের হলেও চিরায়ত গ্রাম বাংলায় সাদাসিধেভাবেই বেড়ে ওঠেন। মধুমতি বিধৌত পাটগাতি ইউনিয়নেই ছিল প্রাথমিক গণ্ডি।
নানার ঘরে থাকতেন। সবাই খোকা বলে ডাকলেও নানা শেখ আবদুল মজিদ তার নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশব থেকেই চরম বাবা ভক্ত ছিলেন। বাবার গলা ধরে ঘুমাতেন, না হয় ঘুম আসত না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদের প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে পড়াশোনা করেন।
এরপর বাবার চাকরির সুবাদে চতুর্থ শ্রেণিতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে, পরে বাবার হাত ধরে মাদারীপুরে ইসলামিয়া বিদ্যালয়ে পড়েন। ১৯৩৪ সালে বেরিবেরি রোগ, আর ১৯৩৬ সালে চোখের গ্লুকোমা ধরা পড়ে। যার কারণে দীর্ঘ চার বছর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হয়নি।
এরই মধ্যে জড়িয়ে যান রাজনীতিতে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তার ভাষ্য, ‘১০ দিনের মধ্যে দুই চোখেরই অপারেশন হল। আমি ভালো হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তখন কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া।’
সেই সভা থেকেই গোপালগঞ্জের খোকা ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। ইংরেজদের শোষণ-বঞ্ছনার বিরুদ্ধে, নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ে মনোযোগী হন। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, ‘তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। স্বদেশী আন্দোলন গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের ঘরে ঘরে। আমার মনে হতো, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার ওপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম।’
এভাবেই রাজনীতিতে জড়িয়ে যান গোপালগঞ্জের খোকা; শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৩৭ সালের কথা। ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। সে বছরই মাস্টার কাজী আবদুল হামিদ এমএসসির হাত ধরে ছাত্র ও জনসেবায় জড়ান শেখ মুজিব। আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টির ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গীরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি।’
সমাজসেবার এই কাজে বেশ কড়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কেউ চাউল না দিলে তাদের ওপর জোর চালাতেন। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, ‘যদি কোনো মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক সেসময় শাস্তি পেতে হত। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।’
কৈশোরের মানবতাবাদী এই শেখ মুজিব এভাবেই কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। অত্যন্ত দুরন্ত ও ডানপিটে খোকা নিজের আত্মজীবনীতে লিখেন, ‘ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’ ১৯৪০ সালে ফুটবল খেলায় ট্রফিও পান শেখ মুজিব।
নিজের স্বভাব নিজেই বঙ্গবন্ধু লিখে গেছেন এভাবে, ‘আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। নালিশ হত।’
শেখ মুজিবের রাজনীতির নেতৃত্বে আসার আরও সুবিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালের একটা ঘটনা থেকে। তিনি লিখেন, ‘শেরেবাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী, তারা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এক্সিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হল। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলল কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সংবর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। আমি এখবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খবই বন্ধুত্ব ছিল। একাসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান-সবই চলত।’
বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। এক্সিবিশন উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চলমান, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে আমার নাম ও বাড়ি জিজ্ঞেস করলেন। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই? বললাম কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই। তিনি নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন, কলকাতা গেলে যেন তার সঙ্গে দেখা করি। আমিও তার চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠি দিতাম।’
পরে ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দীকে বলে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করেন। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারিও নির্বাচিত হন।
এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি এক বছর মেয়াদের জন্য নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় সরাসরি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। এম. ভাস্করণ তাকে ‘সোহ্রাওয়ার্দীর ছত্রতলে রাজনীতির উদীয়মান বরপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওই সময় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান ও ভারত পৃথক হওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি আজকের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। যার মাধ্যমে তিনি এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
সেই ছাত্রনেতা নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত করেন। তার এই নিবেদন তাকে বসিয়ে দেয় ‘বঙ্গবন্ধু’র আসনে। নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির জনক।