রির্পোটঃবিধান সরকার.
বরিশাল প্রতিনিধি.
নিয়মিত তদারকি নেই, প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও নেই নিয়মানুবর্তিতা। ক্লিনিক খোলারও যেমন টাইম-টেবিলের ঠিক নেই, তেমনি বন্ধ করার ক্ষেত্রেও নেই কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা। সবটাই নির্ভর করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) মেজাজ-মর্জির ওপর। তার ইচ্ছে হলে যথাসময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তার ইচ্ছে না হলে বন্ধ থাকে এসব কর্মকাণ্ড। চিকিৎসা নিতে যারা আসেন, অনেক সময় সেইসব রোগীরা অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তালাবদ্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তালা খোলার প্রতীক্ষা শেষ হবে না যখন বুঝতে পারেন, হতাশ রোগীরা তখন বাড়ির পথ ধরেন। বরিশালের অসংখ্য কমিউনিটি ক্লিনিকের চিত্র বর্তমানে এমনই। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যেন চলছে সংশ্লিষ্টদের ইচ্ছেমাফিক!
এদিকে, ক্লিনিকগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। সিএইচসিপিদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সংস্কারের অভাবে জীর্ণ ভবন, ব্যবহারের অনুপযোগী শৌচাগার, স্যালো টিউবয়েল অকেজো থাকা ইত্যাদি নানা কারণে ক্লিনিকগুলোর সেবা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। যদিও জেলার সিভিল সার্জন ডা. এএফএম শফিউদ্দিন দাবি করেছেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে যেন চলে তা নিশ্চিতে তদারকি জোরদার করেছেন তারা। এ ছাড়া ভবন মেরামতের কার্যক্রম শীঘ্রই পর্যায়ক্রমে শুরু হবে।
তিনি জানিয়েছেন, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর জন্য বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রকল্প হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। এর সুপারভিশনে তিনিসহ প্রতি উপজেলায় ট্যাগ অফিসার রয়েছেন। মাসিক সমন্বয় সভায় এর প্রতিবেদন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও স্থানীয় সাপোর্ট গ্রুপের কাছে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের জবাবদিহিতার বিষয়টি রেখেছেন। তবে যেসব এলাকার সিএইচসিপিরা বিলম্বে আসেন বা আগে চলে যান, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই প্রবণতা রোধে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, চালু থাকা ২৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ১৬০টি মেরামত করা প্রয়োজন। এরমধ্যে বানারীপাড়া উপজেলায় ১২টি ক্লিনিক মেরামতের বিষয়টি প্রশাসনিক অনুমোদন পেলেও অর্থ বরাদ্দ হয়নি। অর্থ পেলে পর্যায়ক্রমে সেগুলো মেরামত করা যাবে।
অবশ্য বরিশালের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর এমন অবস্থার মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। বেশ কিছু ক্লিনিক ঠিকমতোই স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চলেছে। সেগুলোতে সেবা পেয়ে সন্তোষও প্রকাশ করছে রোগীরা।
সিভিল সার্জন অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রস্তাবিত কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা ৩০১টি। এর মধ্যে ২৭৯টি চালু রয়েছে, একটি ক্লিনিকের ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। চালু থাকা ক্লিনিকগুলোয় নিয়োগপ্রাপ্ত ২৭০ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)কর্মরত আছেন। পাশাপাশি, শিশুদের টিকা দান কর্মসূচি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়ার জন্য প্রতিটি ক্লিনিকে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীর পর্যায়ক্রমে সপ্তাহে ৩ দিন করে বসার নিয়ম রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটায় গত বছর রোগীর সংখ্যা কমেছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে।
সিভিল সার্জন অফিসের কীট বিষয়ক কুশলী সানজিদা হোসেনের দেওয়া হিসেবে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে। ২০১৬ সালে সেবা গ্রহীতার এই সংখ্যা হলো ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৬ জন। এই হিসেবে রোগীর সংখ্যা কমেছে পৌনে তিন লাখেরও বেশি। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে শিশু প্রসবের সংখ্যা ৪২ থেকে ৩০৩ জনে উন্নীত হয়েছে। চরকাউয়া ইউনিয়নের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সুরাইয়া খাদিজা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য কর্মীরা ধাত্রী বিদ্যার ওপর ৬ মাসের প্রশিক্ষণ পাওয়ায় বছরের ব্যবধানে ক্লিনিকগুলোতে শিশু প্রসবের হার সোয়া ৭ গুণ বেড়েছে বলে।
সম্প্রতি সরেজমিনে জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাধা ইউনিয়নের পাংশা, পশ্চিম পাংশা ও হাদিবাসকাঠি এই তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে প্রথমটি খোলা, দ্বিতীয়টি সকাল থেকেই তালাবদ্ধ এবং তৃতীয়টির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে আগে বন্ধ (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে বাড়ি ফিরেছেন) অবস্থায় পাওয়া গেছে। যদিও সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে পরবর্তীতে হাদিবাসকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি অনুপ কুমার শীল দুপুর ২টার সময় এসে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি খুলেন।
এদিকে, পশ্চিম পাংশা ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. ইমরান হোসেন ওইদিন সকাল থেকেই অনুপস্থিত থাকায় ক্লিনিকটি ছিল তালাবদ্ধ। গেটে তালা দেখে রোগীরা ফিরে গেছেন বলে জানান ক্লিনিক সংলগ্ন বাসিন্দা মুক্তা বেগম। কর্মদিবসে কি কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকটি বন্ধ এ সম্পর্কে আশাপাশের বাসিন্দারাও কিছু জানেন না। ক্লিনিকটির কোথায়াও মো. ইমরান হোসেন মুঠোফোন নম্বর না পাওয়ায় ফিরে আসা রোগীরাও জানতে পারেননি কবে তিনি আসবেন, খোলা হবে ক্লিনিক।
এমনই এক কর্মদিবসে সদর উপজেলার লামচরি কমিউনিটি ক্লিনিকটি বেলা ১১টার দিকে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। পাশের দোকানি জানান, এই ক্লিনিক কখন খোলে আর কখন বন্ধ হয় এ কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। সিএইচসিপি শাহনাজ পারভিনের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে ক্লিনিক খোলা বা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শাহনাজ পারভিন জানান, প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে তাকে ক্লিনিকে আসতে হয়। এ জন্য ক্লিনিক খুলতে বিলম্ব হয়। তার চাকরি হয়েছে ১ নং ওয়ার্ড থেকে, কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩ নং ওয়ার্ডে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে মাহিন্দ্রায় উঠতে হয় তাকে।
হাদিবাসকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্দিষ্ট সময়ের আগে কেন বন্ধ পাওয়া গিয়েছিল, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিএইচসিপি অনুপ কুমার শীল জানিয়েছেন, তিনি ওই দিন স্কুল সংলগ্ন আকন বাড়িতে রোগীর স্যালাইন পুশ করতে গিয়েছিলেন। তিনি নিয়মিত ক্লিনিক খোলেন।
সকাল থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া পশ্চিম পাংশা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. ইমরান হোসেনের সাথে পরবর্তীতে মুঠোফোনে যোগাযোগ হলে তার সোজাসাপ্টা উত্তর-ওদিন আমি ছুটিতে ছিলাম। তবে ক্লিনিক বন্ধ খাকার কথা নয়। কারণ, ওদিন স্বাস্থ্য সহকারীর ডিউটি ছিল। ক্লিনিকের গেটের পাশে আমাদের মুঠোফোন নাম্বার টানানো ছিল, হয়তো কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে।
ইমরান হোসেন আরও জানিয়েছেন, তিনি ক্ষুদ্রকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু ৬ মাস আগে পশ্চিম পাংশার সিএইচসিপি চাকরি ছেড়ে যাওয়ায় তাকে বদলি করে আনা হয়েছে। এতে করে তার যাতায়াতে সমস্যা হয়।
জেলার কমিনিউটি ক্লিনিকগুলোর এমন চিত্রের বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে সরেজমিনে বাবুগঞ্জ উপজেলার পাংশা কিংবা সদর উপজেলার আস্তাকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো কয়েকটিতে গিয়ে। এসব ক্লিনিকে সবকিছুই ঘড়ি ধরে নিয়মমাফিক চলছে। সেবা পেয়ে রোগীরাও তৃপ্ত।
পাংশা মডেল দাখিল মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক আহম্মদউল্লাহ জানিয়েছেন, পাংশা কিমিউনিটি ক্লিনিক নিয়মিত খোলা হয়। সেবা প্রদানকারী আশোক কর্মকারের কাছ থেকে সেবা ও পরামর্শ পেয়ে তারা সন্তুষ্ট। অন্যদিকে, আস্তাকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল থেকেই রোগীর উপস্থিতি দেখা যায়। সেখানকার সিএইচসিপি খাদিজা শিশু থেকে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথা ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি রোগ হলে তারা আস্তকাঠি ক্লিনিকেই আসেন। বড় ধরণের রোগ ছাড়া তাদের শহরের হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যেতে হয় না।
পাংশা কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত সিএইচসিপি অশোক কর্মকার বলেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটি (শুক্রবার) ও সরকারি বন্ধের দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। তার এখানে পালা করে সপ্তাহে ৩ দিন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী শিশুদের টিকা প্রদান এবং মায়েদের পরিবার পরিকল্পনাজনিত সেবা প্রদান করেন।
তবে এই ক্লিনিকগুলোতেও ভৌত-অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সিএইচসিপিরা।