চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পরা মহামারী, প্রানঘাতি ভাইরাস কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশেষ অবদান রাখায় কোভিড-১৯ হিরো অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন বরিশালের সন্তান শেখ গালিব রহমান। গত ১০ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বোরো প্রেসিডেন্ট এরিক এডামস তাকে এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করায় কোভিড-১৯ হিরো সম্মাননা পান তিনি। ব্রুকলিনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ৪ বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের ১৮৮ জনকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়াতে এই খবর মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পরলে আমেরিকান বাংলাদেশি কমিউনিটিতে খুশির জোয়ার বইছে বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি। আমেরিকায় বাংলাদেশি যুবকের কোভিড-১৯ হিরো অ্যাওয়ার্ড পাওয়া নিয়ে আশরাফ সিদ্দিকি নামে এক বাংলাদেশি আমেরিকান জানান, শেখ গালিব রহমান মহামারী করোনার সংক্রমনের শুরু থেকেই খুব সক্রিয়ভাবে কমিউনিটির পাশে থেকেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমন বাড়তে শুরু করলে সরকারের নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন স্টেটগুলো লকডাউন করে দেয়া হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই খাদ্যসামগ্রী শেষ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পরে সাধারন ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তাৎক্ষনিকভাবে শেখ গালিব তার পরিচালিত সংগঠন মুসলিম আন্ট্রাপ্রিনিয়র এসোসিয়েশনকে সাথে নিয়ে হান্ড্রেড মিল চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ছুটে যান অসহায়দের দরজায়। দ্রুত সেবা দিতে চালু করেন হটলাইন। সাহায্যপ্রার্থীরা ফোন করলে তিনি খাবার পৌছে দিতেন বাসায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক রুপ ধারন আর দীর্ঘ লকডাউনে দিনদিন বাড়ছিলো অসহায় মানুষের সংখ্যা। এমন সময় তিনি তার আইটি একাডেমির ক্যাম্পাসে চালু করেন ফুড প্যান্ট্রি। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে তিনি ২০০০ এর অধিক মানুষের কাছে পৌছে দেন খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী। যার ফলশ্রুতিতে মহামারীতে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা ‘প্রথম আলো’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আয়োজনে সম্মাননা প্রদান করা হয় তাকে।
শেখ গালিব সম্পর্কে আরেক বাংলাদেশি আমেরিকান জেরিন সুলতানা জানান, আমেরিকার বাংলাদেশিদের মধ্যে শেখ গালিব খুবই পরিচিত হাস্যোজ্বল মুখ। কমিউনিটির বিপদে আপদে সবসময়ই তিনি পাশে থাকেন, যা একজন জনপ্রতিনিধির মধ্যেও দেখা যায় না। এই করোনা পরিস্থিতিতে আপনজনও অনেককে ছেড়ে চলে গিয়েছেন কিন্তু শেখ গালিব কমিউনিটির মানুষদের নিজের পরিবারে সদস্য মনে করে খাবার নিয়ে ছুটে গিয়েছেন দরজায়। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই মানসিক ও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন ফলে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে দুই ঈদে ছিলনা কোনো খুশির আমেজ। দীর্ঘদিন বাড়িতে আটকে থেকে শিশুরাও বিমর্ষ হয়ে পরেছিল। ঠিক তখনই শেখ গালিব হ্যামিলনের বাশিওয়ালা হয়ে কুইন্সের রাস্তায় দাঁড়িয়ে শিশুদের মুখে হাসি ফোঁটাতে বিতরন করেন খেলনা সামগ্রী। তাছাড়া অনলাইন, অফলাইন , সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক বার্তা প্রদান করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও দেশের প্রতি তার অন্তপ্রান। তিনি একজন গর্বিত বাংলাদেশি, যার জীবনের লক্ষ্যই দেশের জন্য কিছু করা। ব্যাংকার বাবা এস এম সিদ্দিকুর রহমান ও শিক্ষিকা মায়ের সন্তান শেখ গালিব রহমান বরিশাল শহরে জন্মগ্রহন করেন। তার দাদা অ্যাডভোকেট আশরাফ আলী বরিশাল অঞ্চলের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতেন দাদার মতো বড় মাপের একজন আইনজীবী হবেন। বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আইনজীবী হওয়ার বাসনায় এক বছর ঢাকায় আইন বিষয়ে পড়াশোনাও করেন। কিন্তু মাত্র ১৭ বছর বয়সে ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। তারপরই জীবনের মোড় বদলে যেতে শুরু করে গালিবের।
কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনার সময় আমেরিকার ওহাইওতে থাকাকালে অধ্যয়নের পাশাপাশি কিউ এনালিস্ট হিসেবে আইবিএমে প্রথম চাকরি শুরু করেন। ২০১১ সালে সাফল্যের সঙ্গে কম্পিউটার সাইন্স পাস করার পরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে হান্টিংটন ন্যাশনাল ব্যাংক এ কম্পিউটার এনালিস্ট হিসেবে যোগ দেন। এরপর আইটি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন চেজ ব্যাংক, ক্যাপিটাল ওয়ান ও ডিজনি ওয়ার্ল্ডে।ইতোমধ্যে সিআইএস সিসিএনএ মতো ডাটা বেইজ কোর্সগুলো সম্পন্ন হয়। রেগুলার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে লিড এর দায়িত্ব দেন কর্তৃপক্ষ। এ সময় ৪টা সম্মাননা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয় তাকে।
মাত্র ১১ বছরের মধ্যে নিজ কর্মদক্ষতার গুনে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন একজন মেধাবী আইটি টেকনোলজিষ্ট হিসেবে। কাজ করেছেন আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (ডিএইচএস) প্রকল্পে একজন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
ডিএইচএসের সাবেক এ কর্মকর্তা ও আইটি উদ্যোক্তা কাজ করেছেন বিখ্যাত আইটি প্রতিষ্ঠান কেপজিমিনির সঙ্গে। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি, ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডিজিটাল সার্ভিস (ইউএসডিএস) প্রকল্পে আইটি কনসালটিং ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দেন গালিব। ওয়াশিংটন ডিসিতে রিজার্ভ ব্যাংক অব রিচমন্ডে আইটি কনসালটিং ডাইরেক্টর হিসেবে কাজ করেন তিনি।
এব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ গালিব রহমান জানান, ইউনাইটেড স্টেটস অব ইমিগ্রেশন সার্ভিসে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশি খুঁজে বের করে চাকরির সুযোগ দিয়েছেন। এজন্য তার দলে ২০ জনের দলে ১৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। বাংলাদেশি তরুণদের কাজের দক্ষতা সম্পর্কে গালিব রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিভিন্ন প্রজেক্টে এখন অনেক বাংলাদেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। শুধু হোমল্যান্ড ডিপার্টমেন্টের ইউনাইটেড স্টেটস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসে চারটি আলাদা আলাদা এজেন্সি রয়েছে। এগুলো হলো ইউএসসিআইএস, আইইস, সিডিপি ও টিএসএ। এসব এজেন্সিতে এখন অনেক বাংলাদেশি আছেন। শুধু ইউএসসিআই-তে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন বাংলাদেশি কাজ করছেন।
এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ইউএসসিআই, হোমল্যান্ড সিকিউরিটিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করছেন। এটি কেবল কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে থেমে থাকেনি, পেশাদারদের সমন্বয় ঘটিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষাকে বহুমাত্রিকভাবে ছড়িয়ে দিতে গড়ে তুলেছেন নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ট্রান্সফোটেক। জ্যামাইকায় ১৭৩ স্ট্রিট-এ অবস্থিত ‘ট্রান্সফোটেক’-এর মাধ্যমে ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইটি) আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তুলছেন বাংলাদেশিসহ নানা দেশের অসংখ্য তরুণকে। এখানে তরুণদের বহু কাঙ্খিত স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলছেন নতুন প্রজন্মের এই কারিগর। শিক্ষার্থীরা আইটি জগতে তাদের একজন পথ প্রদর্শক হিসেবে দেখছেন গালিব রহমানকে। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণ শেষে এই প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিও নিশ্চিত করা হচ্ছে সরকারী এবং কর্পোরেট হাউজে। এভাবে অসংখ্য পরিবারের কাছে গালিব রহমান একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিতি। এখন গতিময় এক উজ্জ্বল জীবনের নাম। এই প্রতিষ্ঠানটি শত শত তরুণকে উপহার দিচ্ছে সুন্দর এক জীবনের সন্ধান। তাছাড়া কমিউনিটির পার্সোনালিটি বিল্ডিংয়ে কাজ করে চলেছে তার প্রতিষ্ঠান। ইউএস করপোরেট বাজারে বাংলাদেশিদের প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হওয়ার পর এবার তিনি দেশেও কোম্পানিটির একটি শাখা খুলতে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি দেশের শিক্ষকরাও এখানে প্রশিক্ষণ দেবেন। প্রযুক্তি খাতে দেশে এখন পর্যন্ত নির্বাহী পদগুলোতে যোগ্য জনবল তৈরিতে তার প্রতিষ্ঠান এই পেশাদার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশিক্ষণের ধরন সম্পর্কে তিনি বলেন, সফটওয়্যার উন্নয়ন, সফটওয়্যারের মান যাচাই, ডেটা বিশ্নেষণ, সাইবার নিরাপত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করবে ট্রান্সফোটেক। হালনাগাদ রাখতে ছয় মাস পর পর নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সফটওয়্যার উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাভা ও পাইথন প্রোগ্রামের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সফটওয়্যারের মান নিরূপণের বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হবে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের দেশের পাশাপাশি আমেরিকার প্রযুক্তি খাতে চাকরি পাইয়ে দিতে ট্রান্সফোটেক কাজ করবে। আমেরিকা প্রতি বছর এইচওয়ান ভিসা দিয়ে যে ৬০হাজার প্রকৌশলী নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুসংহত করতে কাজ করবে।
মূলত তরুন এই উদ্যোক্তা নিজের মেধা দিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ গালিব। তার এ চেষ্টা সফল হলে বাংলাদেশের তরুণদের সামনে নিঃসন্দেহে খুলে যাবে সম্ভাবনার দুয়ার। স্বপ্নবান তরুণ গালিবের লক্ষ্যও তা-ই। ‘দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারা এবং মানুষের উপকার করতে পারাটাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ’ বলে মনে করেন স্বপ্নচারী গালিব রহমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।