>> ট্রাস্টের সভাপতি তিনি, স্ত্রী সাধারণ সম্পাদক
>> সংস্থাটির নেই কোনো কাজের অভিজ্ঞতা
>> কেনাকাটায় রয়েছে অস্বাভাবিক দামও
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আর্থ-সামাজিক বিভাগের প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আর্থ-সামাজিক সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই শেষে তার হাত দিয়েই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যায় অনুমোদনের জন্য। সরকারের এ শীর্ষ কর্মকর্তা মাগুরার ‘প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্ট’র সভাপতি। তার স্ত্রী ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক, যিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। মাত্র এক মাস পর স্বপন কুমার ঘোষ অবসরে যাবেন। অবসরে যাওয়ার আগে পারিবারিক প্রফুল্লা প্রতিভা ট্রাস্টের নামে ৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাগিয়ে নিচ্ছেন তিনি!
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য কেন্দ্র, মাগুরা’ নামের প্রকল্পটি ৩১ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা খরচে সমাজসেবা অধিদফতর ও প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্ট বাস্তবায়ন করবে। বিধান অনুযায়ী, সরকারি সাহায্য/সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থার সংশ্লিষ্ট খাতে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সেই অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প অনুমোদনের কাজ!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মার্চ মাসে আর্থ-সামাজিক বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন স্বপন কুমার ঘোষ। এর মধ্যেই ‘প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য কেন্দ্র, মাগুরা’ নামের প্রকল্পটি নিয়ে আসেন তিনি। প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করবে আর্থ-সামাজিক বিভাগ, যার প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ নিজেই। আগামী এক মাসের মধ্যে তার অবসরে চলে যাওয়ার কথা। তিনি চেষ্টা করছেন যত দ্রুত সম্ভব পদে থাকাবস্থায় প্রকল্পটির অনুমোদন করিয়ে নেয়ার। অভিযোগ রয়েছে, কাজটি দ্রুত করার জন্য তিনি অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ওপর চাপও প্রয়োগ করছেন।
এ বিষয়ে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘এক মাসে প্রকল্প পাস হয় না, দুই মাসে পাস হয় না, আমি কি নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে করছি?’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না থাকলে কিংবা অতীব জরুরি না হলে এক বা দুই মাসে কোনো প্রকল্প অনুমোদন পায় না।
‘আপনি প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্টের সভাপতি। আপনার স্ত্রী এ ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক। অন্যদিকে আপনি সরকারের আর্থ-সামাজিক বিভাগেরও প্রধান। আর্থ-সামাজিক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থেকে এ বিভাগ থেকেই আপনার ট্রাস্টের জন্য সরকারি প্রকল্প নিচ্ছেন। বিষয়টা কতটা বিধিসম্মত ও নৈতিক’— এমন প্রশ্নের জবাবে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘আপনারা লিখে দেন যে, ওই লোকটা অন্যায় করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কোনো প্রজেক্ট নাই। এটা সরকারের। আমি কোনো কাজ করি না। আমি কোনো প্রকল্প নিতে পারি? বলেন?’ তাহলে এই প্রকল্পটা কার? জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) কিছু আছে। আমি আমার সব জায়গাজমি এখানে দিয়ে দিছি। আমি দান করে দিছি। এখানে যদি একটা শিশুকল্যাণ কেন্দ্র হয় বা একটা এতিমখানা হয়, এখনও আমি কিছু লালন-পালন করি। আমার ওখানে একটা টিনের ঘর আছে। কিন্তু বেশি লোক তো আর থাকতে পারে না।’
স্বপন কুমার ঘোষ আরও বলেন, ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) কথা বলছেন তো। এখানে সরকার আমাকে যে টাকা দিচ্ছে, ওই টাকা যদি আমি আমার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করি, সেটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। সেটা নেয়া যাবে না। কিন্তু এটা যদি এতিম বাচ্চাদের কাজে ব্যবহার হয়, তাহলে তো আমার কোনো কিছু আসল না।’
‘আমি পরিকল্পনামন্ত্রীকে (এম এ মান্নান) বলেছি। আমি বলেছি, স্যার (পরিকল্পনামন্ত্রী) এটা আমি করেছি। মন্ত্রী বললেন, এটা ভালো কাজ’— যোগ করেন স্বপন কুমার ঘোষ।
বিষয়টি বিস্তারিত শোনার পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কোনো অভিযোগ লাগবে না। মূল বিষয়টা সাদা কাগজে কোনো পরিচয় ছাড়া আমাকে লিখে দেন। যেন আমি মনে রাখতে পারি এবং খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি। আমি বিষয়টা ইমিডিয়েটলি (অবিলম্বে) দেখব।’
গত ১ অক্টোবর প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইদিন সকালে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদকে ফোন করা হয়, তবে তিনি রিসিভ করেননি। বিকালে ফোন রিসিভ করলে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের পিইসি সভার আগে বিষয়টি জানতে পারলে আমি আরও শক্তভাবে তাকে (স্বপন কুমার ঘোষ) ধরতাম। তিনি ট্রাস্টের সভাপতি, তার স্ত্রী সাধারণ সম্পাদক, এটা তো আমি জানতাম না। আমি যদি ধরতে পারতাম তাহলে বলতাম যে, আপনারা এত লোক কেন ওটার মধ্যে? মিটিংয়েই এসব জিনিস ধরতাম। তবে আমি জানতাম, ওনার বাড়ি ওখানে (মাগুরায়)। এখন ওনার বাড়ি ওখানে বলে যে প্রকল্প হবে না, তা তো নয়। তাছাড়া এটা জানবে মন্ত্রণালয়, জানবে অধিদফতর। তারা এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে না?’
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে ট্রাস্টের প্রধান হতে পারে, অবৈতনিক যেকোনো কাজ করা যাবে। এতে কোনো আইনগত বাধা নেই। কিন্তু কোনো টাকা-পয়সা সেখান থেকে তিনি নিতে পারবেন না। তার এখানে প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। উনি আমার অধীনে চাকরি করেন। উনি তো একবারও বললেন না যে, এটা আমার কিছু। আমি তাহলে তো…।’
প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্টের ২ বছরও অভিজ্ঞতা নেই
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন মত দিয়েছে যে, সরকারি সাহায্য/সহযোগিতা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যাশী সংস্থার প্রস্তাবিত কার্যক্রমের অন্তত দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আলোচ্য সংস্থার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থ-সামাজিক বিভাগের প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘এটা ইচ্ছা করলে তো আমি নাও লিখতে পারতাম। আমি বলেছি, এখানে যে জিনিস আছে, কোনো কিছু গোপন করব না।’
দুই বছরের অভিজ্ঞতা না থাকার পরও তাহলে কেন এ প্রকল্প অনুমোদন পেতে যাচ্ছে, সেটার জবাব দিতে পারেননি স্বপন কুমার ঘোষ।
এ বিষয়ে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বানিয়েছে, তাদের প্রশ্ন করেন। এগুলো আমার দেখার বিষয় নয়।’
পরিকল্পনা কমিশন মতামতে আরও বলেছে, অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থার মোট আয়-ব্যয় চার লাখ ২৮ হাজার টাকা, যা দিয়ে সংস্থার আর্থিক সক্ষমতা পরিমাপ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এর জবাবে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘এখন আমি আপনাদের রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করি, আপনারা লেখেন। যদি অন্যায় হয়, আমি জেলে যেতেও রাজি আছি। যদি ন্যায় হয়, আমি ন্যায়ের পথে থাকব।’ জেনেশুনে ভুল করছেন কি-না, জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জেনেশুনে ভুল করছি না।’
কেনাকাটায় অস্বাভাবিক দামের বিষয়টি স্বীকার
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) থেকে জানা যায়, কাঠের পাঁচটি চা খাওয়ার টেবিল কেনা হবে। ২৫ হাজার টাকা করে পাঁচটি টেবিলের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘এটা তো পাস হয়ে যায়নি। এটা হবে না। কারণ ওখানে টি-টেবিলের দাম ২৫ হাজার টাকা কেন হবে? এর প্রত্যেকটার পরিবর্তন হবে। আমি বলেছি কমানোর জন্য।’
প্রকল্পে ১০টি চায়না টেবিল লাইট কেনা হবে। এসব লাইটের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা করে। ফলে ১০টি টেবিল লাইট কিনতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
একটা টেবিল লাইট পাঁচ হাজার টাকা হয়? জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো একটাও হবে না। শোনেন, এগুলো তো পাস হয়ে যায়নি।’
ডিপিপি থেকে আরও জানা যায়, পাঁচ হাজার টাকা করে ৫০টি ভিজিটর চেয়ার কেনা হবে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকায়। ১০ হাজার টাকা করে ২০টি আলনা কেনা হবে দুই লাখ টাকায়। একটি কনফারেন্স টেবিল কেনা হবে আড়াই লাখ টাকায়। ৪০ হাজার টাকা করে ১০টি সোফা কেনা হবে চার লাখ টাকায়। ৪৫ হাজার টাকা করে ২০টি বড় টেবিল কেনা হবে ৯ লাখ টাকায়। ছয় হাজার টাকা করে ২৫টি ম্যাট্রেস কেনা হবে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায়। ১৫ হাজার টাকা করে পাঁচটি স্টিলের র্যাক কেনা হবে ৭৫ হাজার টাকায়। এমন ২৯টি খাত দেখানো হয়েছে, সবগুলোতেই বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
‘আপনি আর্থ-সামাজিক বিভাগের প্রধান। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যখন বাড়তি খরচ পাঠায় তখন আপনারা সেসবের দাম যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এমন একটা পদে থেকে জেনেশুনে কেন বাজারদরের চেয়ে এত বাড়তি প্রস্তাব করলেন’— জানতে চাইলে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘প্রস্তাব করছে…। ওই যে অনেক সময় যে…। আমি বলছিলাম যে, এরকম কিছু লাগবে। এটা যখন উপস্থাপন করছে, আমি বলছি, এটা হবে না।’
এ বিষয়ে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘চাইলেই যে সব পাবে, তা নয়। সেখানে তারা চাইছেন, এটা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর প্রকল্প পাঠাবে। প্রকল্প তো দিতেই পারে। কেউ কামান চাইলেই আমরা দিয়ে দেব? আমরা বলে দিয়েছি, এভাবে হবে না। আপনারা ওখানে (ট্রাস্ট) ভিজিট করেন। যৌক্তিকভাবে দেন।’