নজরুল ইসলাম তোফা:: মেঘাচ্ছন্ন আকাশে খুব সকাল বেলা অর্থাৎ সাড়ে ৬টায় রাজশাহী শহর থেকে একত্রিত ইয়ামাহা রাইডার ক্লাবের বৃহৎ টিম। মোট ২২ জন ব্যক্তি ১৬ টি ইয়ামাহা মোটর চড়ে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই চাপাইনবাবগঞ্জের দিকে রওনা হন। শুধু রাজশাহীতে চা খেয়ে সবাই গোপালপুর পৌঁছে। সেখানে সকালের নাস্তা হয় বিখ্যাত একটি মিষ্টির দোকানে। সেখানকার মিষ্টি না কি খুব বিখ্যাত। বৃষ্টিতে ভেজা নাস্তানাবুদ অবস্থায় যেন নাস্তা হয় পরাটা ও ভাজিসহ সেই বিখ্যাত মিষ্টি। তারপর সেখান থেকে শুরু হয় বৃষ্টি ভেজা অবস্থাতেই বিরতিহীন মোটর চালানো। একটানেই গিয়ে দাঁড়ান মহানন্দা নদীর সুন্দর একটি ব্রীজে। ২২জন ব্যক্তির ১৬টি মোটর প্রবল বৃষ্টিতে মহানন্দা ব্রীজের নান্দনিক দৃশ্য ফুটে উঠে। সারি করে মোটর দাঁড় করিয়ে উত্তাল নদীর মনোরম দৃশ্য সহ দু’ধারের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করে ছবি তোলা শুরু হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে গোটা উত্তরবঙ্গের নানান এলাকাতেই পানি জমে। রাস্তার যেসব জায়গা গুলো অনেক নীচু সে জায়গায় কাদা পানি জমে মোটরের চাকা লেগে ছিটকে পড়ে তাদের অনেকের কাপুড়চুপুড় খুবই ময়লা হয়েছে। তবুও তারা ভ্রমণের মজা নিতে পিছপা হননি। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় তিনজন ব্যক্তি পিছপা হয়েছে।
রানীহাটি কলেজের কাছেই রাস্তার বাঁকে এক দুর্ঘটনাও ঘটে। অটো রিকশা ও ইয়ামাহা মোটরের একটি সংঘর্ষ। এমন সংঘর্ষে কোনো মানুষের ক্ষতি হয় নি। অবশ্য বেশ ক্ষতি হয়েছে বহরের সর্বপ্রথম “ইয়ামাহা” মোটরটি তার। জানা যায় যে, অটো রিকশা চালক এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে অটো চালাচ্ছিল। রাস্তার বাঁকে ও বৃষ্টির পানিতে অটো রিকশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। ভ্রমণের সেই মোটর চালককে নাম রনি। দুর্ঘটনার সেই রনিসহ ৩ জন ব্যক্তি ভ্রমণ হতে বাড়ি ফিরে আসে। এখানে উল্লেখ করার করার মতো রানীহাটি কলেজের সামনের একটি চায়ের দোকানে দুর্ঘটনার কারণে সবাই বসেছিলেন। সে দোকানের মালিক একজন ‘বাউল’, তিনি ভ্রমণের ব্যক্তি নজরুল ইসলাম তোফাকে ভালোবাসে বিনা পয়সায় চা খাওয়ায়েছিলেন। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত হলো ভ্রমণ হবে, সবাই বাংলাদেশের সোনা মসজিদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রওনা দেন। এখানে বলে রাখি, ছোট সোনা মসজিদ আসার আগে বৃষ্টি একেবারেই থেমে যায় এবং আকাশ পরিষ্কার হয়।
বাংলাদেশের অন্যতম একটি খুব প্রাচীন সোনা মসজিদ আছে। তাকে “ছোট সোনা মসজিদ” বলে। এমন প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরী’র উপকণ্ঠেই পিরোজপুর গ্রামের পাকা রাস্তার ধারে এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছে। ছোট সোনা মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত, উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অধীনেই পড়ে। ‘সুলতান আলা-উদ-দীন শাহ’ এর শাসন আমলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে) ওয়ালি মোহাম্মদ নামের ব্যক্তিটি এ ছোট সোনা মসজিদ নির্মাণ করেছিল। ইয়ামাহা মোটরস ক্লাবের সকল সদস্যবৃন্দ এ মসজিদে ‘বাংলাদেশের শেষ সীমানা’য়’ যাওয়ার আগেই নামাজ পড়েছে। মসজিদের মাঝের দরজার উপর প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকেই অনেক তথ্য জানা যায়। সুতরাং কালের বিবর্তনে সেই লিপির তারিখের অংশটুকু ভেঙে যাওয়ায় নির্মাণ কাল জানা যায় নি। এটির কোতোয়ালী দরজা থেকে মাত্র ৩ কি.মি. দক্ষিণে। এ ছোট মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। মসজিদের পাশেই বিশাল দীঘি রয়েছে। মনোরঞ্জনের জন্যেই কেনাকাটার ছোটবড় মিলে ক’টি দোকান রয়েছে। নান্দনিক অবয়বে হোসেন-শাহ এ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি হওয়া মসজিদ, যা অবশ্যই দেখার মতো।
ভ্রমণের এক পর্যায়ে খোঁজে খুব কষ্ট করেই পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের তাহখানা। ‘তাহখানা’ পারসিয়ান শব্দ যার আভিধানিক অর্থটা হচ্ছে- “ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ”। এটি গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর এলাকাতে এক বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। পুরনো এমন ভবনটির উত্তর-পশ্চিমে আরো ২টি কাঠামো আছে, তার নিকটস্থ একটি ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। আর একটুখানি উত্তরে অবস্থিত ভল্টেড বারান্দা ঘেরা একটি গম্বুজ সমাধি। এ কমপ্লেক্সরটি কে নির্মাতা তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে এমন ভবনগুলোর স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য, সুলতানি রীতির সৌধ সমূহের মাঝে বিষম বৈশিষ্ট্যের মুঘলরীতির প্রয়োগ বা সমসাময়িক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক বিবরণই ইঙ্গিত বহন করে তাহখানাটির নির্মাতা- “মুগল সুবাহদার শাহ সুজা” (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ) । তিনি সুফী সাধক “শাহ নেয়ামতউল্লাহ ওয়ালী’র” প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ মাঝে মাঝেই গৌড়-লখনৌতি যেতো। তিনি সেখানে অবস্থান করতো। রাজমহলেই ছিল শাহ সুজার রাজধানী, যা গৌড় থেকে খুব দূরে নয়। তবে প্রায় গৌড়ে তার ভ্রমণ হতো, সেখানে অবস্থিত এক “লুকোচুরি দরওয়াজা” নামক জাকজমক পূর্ণ ‘মোঘল তোরণ’ এই যুক্তিটিকে আরও বেশি অকাট্য করে তুলেছে।
সম্ভবত শাহ সুজা দরবেশের খানকাহ হিসেবে এই ছোট্ট প্রাসাদ এবং এর সংলগ্ন মসজিদ ও সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। সমাধিটি সম্ভবত দরবেশের (মৃত্যু ১৬৬৪ অথবা ১৬৬৯ খ্রিঃ) অন্তিম শয়নের জন্য পূর্বেই যেন নির্মিত হয়ে ছিল। আবার সেখানে দ্বিতল ভবনটি মূলত ইটের দ্বারাই নির্মিত। তবে তার দরজার চৌকাঠের জন্যই যেন কালো পাথর আছে। সমতল ছাদের জন্যে কাঠের বীম ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে ভবনটিকে দেখলে একতলা মনে হয়। পূর্ব দিক থেকে অবশ্য দ্বিতল অবয়বই প্রকাশ পায়। যার নিচতলার কক্ষ গুলি পূর্ব দিকে বর্ধিত কিংবা খিলানপথগুলি উত্থিত আছে সরাসরিই যেন জলাশয়টি থেকে। ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে একটি গোসলখানা যেখানে পানি সরবরাহ হতো অষ্টভুজাকৃতির চৌবাচ্চার মাধ্যমে জলাশয় থেকে। আর উত্তর পার্শ্বেই একটি ছোট পারিবারিক মসজিদ অবস্থিত এর পেছনে আছে একটি উন্মুক্ত কক্ষ যেটি একটি অষ্টভুজাকার টাওয়ার কক্ষের সাথে সংযুক্ত ছিল। এই টাওয়ার কক্ষটি সম্ভবত ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হতো। প্রাসাদটি প্লাস্টার করা খোদাইকৃত। সেসব অলংকরণ রীতি মোঘল আমলের। এই তাহখানা কমপ্লেক্সটি সুলতানি যুগের নগরে- মুগল রীতির স্থাপত্য নিদর্শনের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থাপত্য বাংলায় প্রথম, নান্দনিকতায় অপূর্ণ।
‘বাংলাদেশের শেষ সীমানা’ বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর শেষ সীমানায় ইয়ামাহা রাইডার ক্লাবের বিভিন্ন সদস্যবৃন্দসহ ইয়ামাহার ১৬ টি মোটর নিয়ে বৃষ্টি ভেজা ভ্রমণ ছিল খুব চমৎকার। রাজশাহী থেকেই বৃষ্টি শুরু, চাঁপাই নবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলে। যদিও এ ভ্রমণে খুব ক্লান্ত হয়ে ছিলাম তবুও মজা নিতে একটুও ক্লান্তিবোধ হয়নি। দুপুরে ভাত, মাংস দিয়ে পেটপুরে খাবার খাওয়ার পরিবেশ ছিল নান্দনিক, আর সেটি ছিল একে বারে বাংলাদেশের শেষ সীমান্তের একমাত্র হোটেল যা ছিল টিনের চাল ও টিন দিয়ে ঘেরা। সেখানে কেউ গরুর মাংস, কেউ রাজহাঁসের মাংস দিয়ে খাবার খেয়েই শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য স্মৃতিময় ছবি তোলার পালা। বাংলাদেশের শেষ সীমান্তের ‘বর্ডার গার্ডরা’ ভ্রমণের সবার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে, তারা ছবি তুলতেও অনেক সহযোগিতা সহ বিভিন্ন তথ্য জানানোর চেষ্টা করেছে। ভ্রমণের এমন আগ্রহের জন্যই সেখানে অবস্থিত বর্ডার গার্ড সহ সাধারণ মানুষরা খুবই আনন্দিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সীমানায় গেলে ভারতীয় মানুষের দেখা ও ভারতীয়রা সীমানায় এলেই বাংলাদেশি মানুষদের দেখা পাবে। শুনা যায় যে, স্থানীয় চাষীরা এই সীমান্তে চাষের জমিতে কাজ করার জন্য প্রতিটি দিন সীমানা অতিক্রম করে। তবে তাদের জন্যই যেন ‘সীমানা অতিক্রম’ শব্দটি সম্ভবত ঠিক প্রযোজ্য নয়। কারণটা হলো, কৃষি কাজের জন্যে তারা শুধুমাত্র তাদের জমিতে যান। বাংলাদেশের শেষ সীমান্তের মানুষের জমি জমা এখনও নাকি ভারত সীমান্তের ওপারে আছে। তাদের জমি এখনও ভারতের মিলিক সুলতান পুর গ্রামে প্রাচীরের ওপরে। এখানকার সীমান্তটি বাংলাদেশ ও ভারতকে আলাদা করেছে- তাই জমির মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি ভাবেই প্রাচীর নির্মাণ হয়েছে। প্রত্যেক দিন সে জমি গুলোতে যাওয়ার আগেই যেন বিএসএফের নিকটে আধার কার্ড (জাতীয় পরিচয় পত্র) জমা দিয়েই তারা কাজ কর্ম যান। বিকেল চারটায় বিএসএফের ক্যাম্প বন্ধ হওয়ার আগেই নিজ দ্বায়িত্বেই কার্ড সংগ্রহ করে ঘরে ফিরেন। তারা সীমান্তের ওপারের জমিগুলোর যত্ন নেয়, চাষ করে, আবার রাতেও পাহারা দেন, যাতে ফসল চুরি না হয়। রাজশাহী বিভাগীয় শহরে না গিয়ে কেনাকাটার জন্যে বাংলাদেশের শেষ সীমানার মানুষগুলো ভারতের মালদাকেই বেছে নেন। চাঁপাইয়ের মানুষ মালদা থেকে নানান জিনিস পত্র কেনাকাটা করে দামেও খুব সস্তা পান। বাংলাদেশের শেষ সীমানা কিংবা ভারতীয়দের মিলনমেলার জিরো পয়েন্টে চোখে পড়বে পুরনো ইটের উঁচু প্রাচীর। সীমান্ত রক্ষীদের উপস্থিতিতে দুদেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে কথা বলা যায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারত এই সীমান্তের ‘সীমান্ত পিলার’ থেকে পাকিস্তান/পাক লেখা মুছে বাংলাদেশ বা বিডি লেখা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্ত পিলার হতে ‘পাকিস্তান বা পাক’ লেখার বদলে ‘বাংলাদেশ/বিডি’ লেখা করেছে। জানা প্রয়োজন যে, ‘বাংলাদেশ-ভারত’ সীমান্তের কোনো পিলারে কিংবা খুঁটিতে ”পাকিস্তান/পাক” লেখা নেই। সীমানা পিলারে বা খুঁটিতে ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাম’। জানা যায় যে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকেই স্বাধীন হয় ভারত কিংবা পাকিস্তান। এরপরই যেন ‘আট হাজারের বেশি’ পিলারে ইংরেজিতে খোদাই করে ‘ইন্দো-পাক/ইন্ডিয়া-পাকিস্তান’ লেখা ছিল। বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের সীমান্তের অনেক সীমানা পিলার বা খুঁটিতে পাকিস্তান/পাক লেখা ছিল। বহু পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো প্রাণের বিনিময়েই পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এ বাংলাদেশ। বিজয়ের এত বছর পরও সীমান্ত পিলার গুলোয় পাকিস্তান/পাক শব্দ ছিল। সে গুলো মুছে দিয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের নাম’ না লেখার বিষয়টি যেন সীমান্তের মানুষের কাছে ছিল খুব বিড়ম্বনার। জানা দরকার, বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই যেন- “বিজিবি সু-দক্ষ মহাপরিচালক, মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম” এর – অধীনস্থ রিজিয়ন গুলোতেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। এরপরই বিজিবির সদস্যরা সীমান্ত পিলারের পাকিস্তান কিংবা পাক লেখা পরিবর্তন করেই বাংলাদেশ/বিডি লেখা হয়েছে। ফলে, সীমান্তবর্তী মানুষ বা বিজিবিদের মনোবল আরো অনেকাংশেই যেন বেড়ে গেছে। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে সীমান্ত পিলারের নাম পরিবর্তন করা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যাক, এই ভ্রমণে সন্তষ্টি প্রকাশ করেছে সবাই। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। বিনোদন সহ বিভিন্ন তথ্যও পেয়েছে।
লেখকঃ
নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।
(Visited ১০ times, ১ visits today)