সিদ্দিকুর রহমান ॥ বিশ্ববিখ্যাত বক্সার মোহাম্মাদ আলী নব্বই’র দশকে বাংলাদেশ ভ্রমণ করে ফিরে যাওয়ার সময় বলেছিলেন- কেউ যদি স্বর্গ দেখতে চাও তাহলে বাংলাদেশে আসো। এ কথার যথার্থতা আমরা খুঁজে পাই সবুজ শ্যামল এই দেশের পরতে পরতে। সেরকমই একটি অপর”প সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিজলা উপজেলার গৌরব্দী ইউনিয়নের চর মেঘা। এটি এমনি একটি স্থান যেখানে গেলে আপনি অদ্ভুত আর অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে পারবেন। মনে হবে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে। এছাড়া চিরাচরিত বাংলার ঐতিহ্যগুলো অনেক আগে থেকেই লালন করে আসছে এই চরের মানুষজন। যেদিকে তাকাবেন শুধু সবুজ আর সবুজ। এই চরটির এমনি একটি স্থানে অবস্থিত যার উত্তরে মেঘনা নদী, পূর্বদিকে লক্ষীপুর জেলা, দক্ষিন ও পশ্চিমে হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা। বরিশাল জেলা প্রশাসনের নতুন উদ্যোগে অবহেলায় পরে থাকা এই চরটি ঘিরে ঐ উপজেলার মানুষগুলোর মাঝে নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে “স্বপ্ন বুনন-সবুজ বনায়ন” এই স্লোগানে গত সোমবার অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে স্বপ্নের চর মেঘায় ইকো পার্ক ও কাম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপন ও বীজ বপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ নাথ ও বরিশাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান। তাছাড়া এই চরটিকে ঘিরে ইকো পার্ক স্থাপন, বনায়ন, পশু পালন ও পোল্ট্রি খামার তৈরি, পশু সম্পদ রক্ষায় কিল্লা নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র, মৎস্য চাষ, ফুল ও সবজী চাষ, বিভিন্ন ফসলের খামার নির্মাণ, সয়াবিন উৎপাদন প্রভৃতিসহ দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে শিল্প স্থাপন করে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা নতুন সম্ভাবনাময় জনপদ প্রতিষ্ঠা করতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।
হিজলা উপজেলা সদর থেকে ২৩ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত হিজলা গৌরব্দী ইউনিয়নের চর মেঘা মৌজার প্রায় ২ হাজার ২৫৬ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত এই চরটি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই চরটিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করে ইকোপার্ক ও বনায়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে চলতি মাসে চারা উৎপাদন শুর” করে সেপ্টেম্বর মাসে বরিশাল জেলা সদর, হিজলা উপজেলাসহ বরিশালের বিভিন্ন উপজেলার ১০ হাজার মানুষের অংশ গ্রহণে এবং জন প্রতি ১০০টি করে এক দিনে ১০ লাখ গাছের চারা রোপণের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যার ফলে গনমানুষের অংশ গ্রহনে এই কর্মসূচিকে ঘিরে বাংলাদেশে নতুন করে আরো একটি গনজাগরনের সৃষ্ঠি হবে। তাছাড়াও এই চরটি ঘিরে ইকো পার্ক ও ইপিজেড হলে, এখানকার হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি উন্নয়ন হবে এই চরটিতে বসবাসরত হতদরিদ্র মানুষের । বর্তমানে বিদ্যুৎ নেই চর মেঘায়। কেউ কেউ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করলেও তার সংখ্যা অনেক সীমিত। নানা অবহেলায় অবহেলিত এই চরের বসবাসরত বাসিন্দা ও তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য নেই তেমন কোন সুযোগ সুবিধা। স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রচেস্টায় কয়েকদিন আগে নতুন একটা বিদ্যালয় করা হয়েছে। কিন্তু এখনো শুর” হয়নি এর পাঠদান কার্যক্রম। এছাড়াও এখানের মানুষের চিকিৎসা নিতে পাড়ি দিতে হয় অনেক পথ। তারপরে মিলেনা তাদের কাংখিত চিকিৎসা সেবা। তাই এই ইকো পার্ক কাম অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পূর্নরূপ পেলে এখানের মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যথাযথ উন্নয়ন হবে বলে আশা করছেন ঐ এলাকার বাসিন্দা আলী আসাদালী সিকদার (৬৮)। তিনি জানান, বাবা মোরা গরীব মানুষ, তাই এই চরে ১১ বছর ধরে আছি। যখন এই চরে আইছি তখন এখানে তেমন কোন মানু থাকতো না। তবে এহান দিয়া বিভিন্ন ধরনের মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হওয়ার কারনে এখন কিছু মানুষের আনাগোনা রয়েছে এই চরটিতে। তিনি আরো বলেন, ১৯৮৭ সালে নদী ভাঙ্গনের পর এই চরটি জেগে উঠে। পরবর্তীতে কিছু মানুষ এখানে এসে বসবাস করতে শুর” করে। তবে শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় কেউই এই চরে থাকতে চায় না।
এদিকে এই চরটিতে বসবাস করে অনেক বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে কিছু ভিন্ন চিত্র, অনেকেই ভাবে এই চরটি অবহেলিত। কিন্তু আসলে বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। এই চরটিকে আশেপাশের কিছু প্রভাবশালী মহল এর ভোগ দখল করে ব্যবসা করে আসছে। এই চরটিতে চাষাবাদ থেকে শুর” করে, গর”-মহিষ পালন, হোগলপাতা কাটা, আশে পাশে মাছ ধরার ক্ষেত্রে নানান হারে এই অর্থ দিতে হচ্ছে তাদেরকে। তাছাড়া এই চরটি হিজলা উপজেলার হলেও এর রাজত্ব করছে নোয়াখালী ও মেহেন্দিগঞ্জের প্রভাবশালীরা। তবে ইকো পার্ক নির্মান হলে বৃক্ষরাজির ফলে এই চরটি আর ভাঙ্গনের কোন সম্ভাবনা থাকবে না বলে জানায় তারা। তাই জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি এই চরকে কেন্দ্র করে নতুন যে পার্ক এবং কাম অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এই চরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই বাসিন্দাদের । এদিকে এই পার্ক নির্মানে জেলা প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন চরটিতে বসবাসরত বাসিন্দারা।
এদিকে হিজলা উপজেলার গৌরব্দী ইউনিয়নের চর মেঘা মৌজায় স্বপ্নের ইকো পার্ক কাম অর্থনৈতিক অঞ্চল করার রূপকার জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেছেন, চর মেঘা মৌজায় প্রায় ২২৫৬ একর ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমি রয়েছে, যা সম্পূর্ণই জেলা প্রশাসক, বরিশালের নামে রেকর্ডকৃত নিষ্কণ্টক জমি। এই চরটির ভূমি উর্বর, সেচ সুবিধা সম্বলিত। যার শতকরা ৭৫ ভাগ ভূমিই বর্ষাকালে জেগে থাকে। তাছাড়া এই চরে নৌ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও উত্তম। তাই এখানে ইকো পার্ক স্থাপন, বনায়ন, পশু পালন ও পোল্ট্রি খামার তৈরি, পশু সম্পদ রক্ষায় কিল্লা নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র প্রস্তুত, মৎস্য চাষ, ফুল ও সবজী চাষ, বিভিন্ন ফসলের খামার নির্মাণ, সয়াবিন উৎপাদন প্রভৃতিসহ দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীগণের অংশগ্রহণে শিল্প স্থাপন করে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা এই চরটি নতুন সম্ভাবনাময় জনপদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে বলে জানান তিনি। তাই এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানাবিধ কাজ করা হচ্ছে। গত সোমবার এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে গনমানুষের অংশ গ্রহনে প্রাথমিক ভাবে ১০ লাখ গাছের চারা রোপনের মধ্যে দিয়ে এই ইকোপার্কের যাত্রা শুর” হবে। এছাড়াও এর পাশাপাশি দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীগনদের এখানে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করা হবে। যাতে পরবর্তীতে এখানে বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠে, এখানকার বাসিন্দাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়। এদিকে ইকো পার্ক গড়ার ক্ষেত্রে চর মেঘার বাসিন্দাদের উৎসাহ এই কাজটি সফল ভাবে করা সম্ভব হবে। আর এই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশে র”পান্তরে আরো একধাপ এগিয়ে নিবে বলে আশাব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান।