রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে যে অর্থ আত্মসাৎ করতেন তার বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার করতেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
রোববার (২৬ জুলাই) সন্ধ্যায় র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
তিনি বলেন, তার অর্থ পাচারের বিষয়ে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) অনুরোধ জানিয়েছি। সিআইডি তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ করিম তার প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বিভিন্ন মানুষকে অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। তার বক্তব্য, মূলত অর্থ আদায়ের জন্যই তিনি প্রতারণা করেছেন। অর্থাৎ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেয়াই তার আসল উদ্দেশ্য ছিল।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরার দেবহাটাতে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র মামলায় কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে র্যাব-৬ খুলনায় রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে অস্ত্রের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি বলেন, র্যাব বাদী হয়ে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। প্রতারণার অভিযোগে প্রথম মামলা দায়ের হয় উত্তরা পশ্চিম থানায়, দ্বিতীয় মামলা (অস্ত্র) সাতক্ষীরার দেবহাটাতে, তৃতীয় মামলা জাল নোট উদ্ধারের বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় করা হয়। তিনটি মামলা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক র্যাব অনুমতি পেয়েছে। অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
করোনায় নানা প্রতারণার দায়ে গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার দেবহাটা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারে পর সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর দ্বিতীয় দফায় রোববার তাকে ফের ২৮ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
করোনায় সাহেদের কাণ্ড
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছিল রিজেন্ট। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ৪ হাজার নিতেন। বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হতো। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালটি। পরীক্ষা না করেই বাকি ৬ হাজারের মতো নমুনার রিপোর্টই মনগড়াভাবে তৈরি করে দেয় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবেও অনুমোদন পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট। এতে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়ার কথা ছিল না। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে, রিজেন্টে রোগীপ্রতি দেড় লাখ, দুই লাখ ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছিল। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এই অর্থ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত পায়নি হাসপাতালটি।
এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনা টেস্টের অননুমোদিত কিটও পায় র্যাব। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যে কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি, সেটি দিয়েও টেস্ট করে রিজেন্ট। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কোনো টাকা নেয়ার কথা নয়। টেস্টে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিত তারা। যাদের ‘করোনা পজিটিভ’ রিপোর্ট দেয়া হতো, তাদের কাছ থেকে ফের পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা নেয়া হতো।
সাহেদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ
অভিযোগ থাকায় গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরার শাখায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সেখানেই সাহেদের পাপ সাম্রাজ্যের প্রথম দ্বার উন্মুক্ত হয়। এরপর থেকেই পলাতক সাহেদ। সাহেদকে পলাতক দেখিয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। সিলগালা করা হয় উত্তরার রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়সহ মিরপুরের শাখাটিও। ফ্রিজ করে রাখা হয় সাহেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব। রিমান্ডে নেয়া হয় তার অপকর্মের সহযোগীদের।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন সাহেদ
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর আগে গ্রেফতার এড়াতে কয়েক দিন ধরেই সাহেদ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ একদিন এ জায়গায় তো পরদিন অন্য জায়গায়। র্যাব তাকে ফলো করে।