আইন বিষয়ে না পড়েও রাজধানীর উত্তরায় একটি বাড়ির চতুর্থ তলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ল’ চেম্বার খুলেছিলেন বহুমুখী প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদ।
অথচ আইন বিষয়েই পড়াশোনা করেননি সাহেদ, নেই এ বিষয়ের ওপর কোনো ডিগ্রিও। তারপরও ল’ চেম্বার করেছিলেন তিনি। রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাসার চতুর্থ তলায় তার ল’ চেম্বার।
বুধবার (১৫ জুলাই) দুপুরে এই বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাবের একটি সূত্র।
দু’মাস আগে উত্তরার ফ্ল্যাটটি ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন তিনি। গত দু’বছর ধরে বাড়িটির কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. তারা মিয়া।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত দুই মাস আগে সাহেদ করিমের লোকজন এ বাড়ির চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট দেখে বাড়ির মালিক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করেন। চুক্তি অনুযায়ী মাসে ৩০ হাজার টাকা দেয়ার কথা ছিল। তবে সাহেদ করিম নিজে এখানে আসেননি।’
আটক করার পর প্রতারক সাহেদ করিমকে সঙ্গে নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উত্তরার এ বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অভিযান শেষে দুপুর ১টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাহেদ করিমকে র্যাব হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে অভিযানে কিছু উদ্ধার হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম।
বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীরবর্তী সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।
করোনায় সাহেদের কাণ্ড-
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছিল রিজেন্ট। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ৪ হাজার নিতেন। আর বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হতো। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালটি। পরীক্ষা না করেই বাকি ৬ হাজারের মতো নমুনার রিপোর্টই মনগড়াভাবে তৈরি করে দেয় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবেও অনুমোদন পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট। এতে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়ার কথা ছিল না। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে, রিজেন্টে রোগী প্রতি দেড়লাখ, দুইলাখ ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছিল। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এই অর্থ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত পায়নি হাসপাতালটি।
এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনা টেস্টের অননুমোদিত কিটও পায় র্যাব। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যে কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি, সেটি দিয়েও টেস্ট করে রিজেন্ট। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কোনো টাকা নেয়ার কথা না। তবে টেস্টে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিত তারা। যাদের ‘করোনা পজিটিভ’ রিপোর্ট দেয়া হতো, তাদের কাছ থেকে ফের পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা নেয়া হতো।
সাহেদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ-
অভিযোগ থাকায় গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরার শাখায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সেখানেই সাহেদের পাপ সাম্রাজ্যের প্রথম দ্বার উন্মুক্ত হয়। এরপর থেকেই পলাতক সাহেদ। সাহেদকে পলাতক দেখিয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। সিলগালা করা হয় উত্তরার রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়সহ মিরপুরের শাখাটিও। ফ্রিজ করে রাখা হয় সাহেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব। রিমান্ডে নেয়া হয় তার অপকর্মের সহযোগীদের।
কোথায় পালিয়ে ছিলেন সাহেদ-
র্যাব ডিজির ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একেকদিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। ঢাকা, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুকৌশলে আত্মগোপনে ছিল সে। দেবহাটার কোমরপুর সীমান্তে লবঙ্গবাতি খাল দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করলে সে ধরা পড়ে।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন সাহেদ-
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গ্রেফতার এড়াতে গত কয়েকদিন ধরেই সাহেদ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ একদিন এ জায়গায় তো পরেরদিন অন্য জায়গায়। র্যাব তাকে ফলো করে। গ্রেফতার বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক জানান, ‘সে ঢাকা ছেড়েছে আবার ঢাকায় ফিরেছে, আবার বেরিয়েছে। এসবের মধ্যেই ছিল। এই পুরো সময়টাতে সে কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করেছিল। অবশেষে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় আমরা তাকে ধরতে সক্ষম হয়েছি’।
সাহেদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম জানান, ফজরের নামাজের জন্য তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই তাদের কানে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। শুরু হয় হইচই। ঘটনা কী দেখার জন্য দৌড়ে যান সবাই। গিয়ে যা দেখলেন, সারা দেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র্যাব।