সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়নি বলেই ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েই বিএনপি-জামায়াত জোট তখন ক্ষমতায় এসেছিল।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের উপর দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী খান।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, গণতন্ত্র আছে বলেই তো উন্নয়ন হচ্ছে। আমাদের আগে যারা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। কই দেশে এতো উন্নয়ন হয়নি? আমরা ৮ বছরে যা করতে পারলাম, অতীতে যারা ছিল তারা পারেনি কেন? সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, যদি আমাদের সমালোচনা করতে হয়। তারা পারেনি তো আমরা পারি কেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, প্রত্যেক কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করি। জনগণের কল্যাণে, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করি। নিজের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করি না।
তিনি বলেন, যদি এটা হতো (নিজের জন্য কাজ করতাম) তাহলে ২০০১ সালে যখন বলা হলো, আমার গ্যাস বিক্রি করতে হবে। গ্যাস বাংলাদেশের। বিক্রি করবে আমেরিকার কোম্পানি। কিনবে ভারত। আমি রাজি হইনি। আমার দেশে যদি গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে সেই গ্যাস আগে ব্যবহৃত হবে দেশের মানুষের কল্যাণে। আমার ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। উদ্বৃত্ত হলে আমি বিক্রি করবো, তাছাড়া বিক্রি করবো না। এই কথা বলার পর ২০০১ সালে সরকারে আসতে পারিনি। আর যারা গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েছিল সেই বিএনপি-জামায়াত জোটই ক্ষমতায় এসেছিল। আমি বলেছিলাম, গ্যাস তারা পাবে না। দিতেও পারব না। তাই ই হয়েছে। গ্যাস পায়ওনি, দিতেও পারেনি। কারণ আমাদের তো গ্যাসের সমস্যা আছে। এখন প্রমাণিত হয়েছে, আমি কত সঠিক কথা বলেছিলাম। এখন আমরা এলএনজি আনছি, বেসরকারিখাতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। শীতকালে লাইনে গ্যাস থাকে না, প্রেসার থাকে না। তাই রান্নার কাজে এলপিজি বা বোতলের গ্যাস তথা গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থা আমরা করেছি। বেশি যাতে উৎপাদিত হয় সেজন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতো উন্নয়ন করার পর যারা তৃপ্তি পান না, তারা কি চায় এ দেশে?
গণতন্ত্র আছে বলেই দেশ এতো উন্নয়ন হচ্ছে
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, দেশে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা আছে বলেই দেশে এতো উন্নয়ন হচ্ছে। অনেকে বলেন শুধু উন্নয়ন করলে হবে না, গণতন্ত্র থাকতে হবে। দেশে এতো উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরও যারা কিছুই দেখতে পান না তারা আসলে কি চায়? কাদের মুখে আমরা গণতন্ত্রের কথা শুনি? যাদের মার্শাল’ল বা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচার এলে তাদের পদলেহন করতে ভাল লাগে, পতাকা ও মন্ত্রী হতে পারে, তারাই অবৈধ ক্ষমতা দখলকার থাকলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে পায়। যদি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নাই-ই থাকে তবে সরকারের এতো সমালোচনা তারা করেন কীভাবে?
বাংলাদেশকে আর ভিক্ষা নিয়ে চলতে হয় না
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আর হাত পেতে বা ভিক্ষা নিয়ে চলতে হয় না। আমরা প্রায় ৯০ ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করি নিজেদের অর্থায়নে। পদ্মা সেতুতেও আমরা তা প্রমাণ করেছি। তাই যে যত কথাই বলুক না কেন, এনজিওগুলো একভাগ হারে দারিদ্র্য হ্রাসের অস্বাভাবিক দাবি মানলে তো দেশে দারিদ্র্যতাই থাকে না। বাস্তবতা হচ্ছে দেশে দ্রুত দারিদ্র্যতা কমেছে সরকারের গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আমরা ১৪২টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য।
তিনি বলেন, দেশে খাদ্য ঘাটতি রেখে হাড্ডিসার, কঙ্কালসার মানুষকে দেখিয়ে বিদেশ থেকে ভিক্ষা এনে নিজেদের পকেট ভারি করার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে- এটাই যেন অনেকের ভাল লাগছে না। কারণ এরা দেশের ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ হোক তা চায় না।
ক্ষমতায় যেতে রাজনীতি করলেই হয়
সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের কিছু মানুষ আছে যারা উন্নয়ন দেখলেই সমালোচনা করে। যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন তাদের জরুরি অবস্থা কিংবা সামরিক স্বৈরাচার যখন আসে তখন তাদের কাছে খুব গণতান্ত্রিক মনে হয়। তাদের সঙ্গে একবারে বিগলিত প্রাণ হয়ে পদলেহন করতে শুরু করে। কারণ একটা অস্বাভাবিক ক্ষমতা এলেই ওনাদের একটু গুরুত্ব বাড়ে। যদি ক্ষমতায় যাওয়ার এতোই আকাঙ্খা তাহলে তাদের রাজনীতি করলেই হয়। জনগণের কাছে গেলেই হয়। ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা সংসদে আসুক।
দারিদ্র্য বিমোচন সরকারের নিরাপত্তা কর্মসূচিতে
দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাকসহ অন্যান্য এনজিও’র দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ নয়, দেশে দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে সরকারের গৃহীত ১৪২টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে। একটি ব্যাংকসহ প্রায় আড়াই হাজার এনজিও আছে, তারা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দেশে কতভাগ দারিদ্র্য বিমোচন করেছে? তারা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করেছে নাকি যারা এর ব্যবসা করেন, তারাই ধনশালী ও সম্পদশালী হয়েছে- এ বিষয়ে গবেষণা করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্রাক নাকি প্রতিবছর এক ভাগ হারে দারিদ্র্যতা কমাচ্ছে বলে বলা হয়। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৮৫ সালে, আর ব্রাক প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৮২ সালে। এ দুটি সংস্থা দুই ভাগ হারে বছরে দারিদ্র্য দূর করে, তবে এই ৪৫ বছরে দেশে তো দারিদ্র্যতাই থাকা উচিত নয়। দেশ অনেকে আগেই দারিদ্র্য একেবারে শূন্য হয়ে যাওয়া উচিত। তবে গেল না কেন?
৮ বছরে ৫ লাখ মানুষ নিম্নআয় থেকে মধ্যম আয়ে
দেশে কোন সরকারের আমলে কতহারে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে তা নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস করেছে, অতীতের কোন সরকার তা পারেনি। ৯৬ সালে আমরা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করি তখন দেশের দারিদ্র্যতা ছিল ৫৭ ভাগ। এখন আমরা দারিদ্র্যতা ১২ ভাগে নেমে এনেছি। আমরা ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ নয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখান থেকে ঋণ নিয়ে কাউকে সুদের জন্য বাড়ি-ঘর, গরু বেচতে হয় না। আমাদের দৃঢ় পদক্ষেপের ফলেই এই ৮ বছরে দেশের ৫ লাখ মানুষ নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ে উঠে এসেছে।
টেলিভিশন দিয়েছি বলে এতো কথা বলার সুযোগ
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশে কোনো প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। আমরাই প্রথম বেসরকারিখাতে প্রাইভেট টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বলেই তারা (সমালোচক) এতো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা কিন্তু উন্নয়ন চান না, গণতন্ত্র চান না। দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই তো উন্নয়ন হচ্ছে। আজকে আমরা গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সরকার পরিচালনা করছি বলেই তো দেশের উন্নয়নটা হচ্ছে। আমাদের পূর্বে ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের আমলে এতো উন্নয়ন হয়নি কেন? সেটাই আমার প্রশ্ন। সমালোচনা করতে হলে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
ছেলে-মেয়েরা যাতে জঙ্গীবাদে পা না বাড়ায়
সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্ম মানুষ হত্যার প্রশ্রয় বা সমর্থন করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অনেক উচ্চবিত্ত ঘরের সন্ত্রানরাও জঙ্গীবাদের পথে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের অবস্থান পরিষ্কার আমরা কোনো জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেব না। যে কোনো উপায়ে আমরা এসব দমন করবোই। তিনি এ সময় ছেলে-মেয়েরা যাতে বিপথে না যায়, জঙ্গীবাদের সর্বনাশা পথে পা না বাড়ায় সেজন্য অভিভাবকসহ দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
মানুষকে বিভ্রান্ত ও উন্নয়ন কাজে বাধা
রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে সংসদের বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা অতো সহজ কাজ নয়। অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর রামপালে যে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে তার থেকে সুন্দরবন ১৪ কিলোমিটার দুরে। সুন্দরবনে নয়, বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে রামপালে। আর এটি হচ্ছে সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট। বিদ্যুতকেন্দ্রের ধোঁয়া কোনোভাবেই সুন্দরবনের দিকে যাবে না। আর এই প্রকল্প এলাকায় ৫ লাখ বৃক্ষ লাগানো হবে, ইতোমধ্যে দেড় লাখ গাছ লাগানো হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কিছু লোক আছে কোন কিছু করতে গেলেই বাধা দেয়। জার্মানের মিউনিখে শহরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র আছে। সেখানে কী পরিবেশে ক্ষতি হয়েছে? দিনাজপুরেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে কী পরিবেশ নষ্ট হয়েছে? সেখানে কী ধান চাষ হচ্ছে না? গাছ-পালা কিংবা মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নেই? আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং উন্নয়ন কাজে বাধা দেওয়াই কিছু মানুষের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুভুক্ষ মানুষের হাহাকার দেখেছি
সরকারের নানা উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছি। বুভুক্ষ মানুষের হাহাকার দেখেছি। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষকে দারিদ্র থেকে মুক্ত করা। জীবন মান উন্নত করা। ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব করতে শুরু করি। বয়ষ্ক ভাতা, বিনা সুদে বর্গাচাষীদের ঋণ দিয়েছি। প্রায় ৪ কোটি ২৬ লাখ প্রি প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দিয়েছি। এক কোটি ৭৩ লাখ ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি/উপবৃত্তি পাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই মানুষকে শিক্ষিত করতে পারলে দারিদ্র্যবিমোচন দ্রুত হবে। কৃষিতে ভর্তুকি ৯৬ সাল থেকেই দিয়ে আসছি। ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার কৃষি কার্ড দেওয়া হয়েছে। যাতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। যেহেতু চাষাবাদের জমি কম। গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়েছি। বাংলাদেশ এখন খাদ্য স্বয়ংসম্পন্ন। ১০ টাকা কেজি দরে প্রায় ৫০ লাখ লোককে চাল দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের সমালোচনাকারীদের বঙ্গবন্ধুর সরকার পরিচালনা নিয়ে সমালোচনার কথাও মনে করিয়ে দেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী, কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ তারা কিন্তু জাতির পিতাকে সময় দিতে চায়নি। তাদের সমালোচনা, নানা আলোচনা, বিভিন্ন কারণে যারা এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ছিল; তাদেরকেই শক্তিশালী করেছিল। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল; যার ফলাফলটা পেলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট।