ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে স্বভাব-সুলভ হাস্যরসে মজার মজার কথা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরে নির্মল আনন্দ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আজ শনিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজিত এ সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি যখন নিজের লিখে আনা বক্তব্যের বাইরে কথার সূচনা করেন, তখনই পুরো সমাবেশ হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানায়।
রাষ্ট্রপতির কথার মাঝে মাঝেই উঠে হাসির রোল আর করতালি। রাষ্ট্রপতি মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় ১৩ মিনিট নির্ধারিত লিখিত বক্তব্যের বাইরে তাঁর জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়েকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার নানা মুহূর্ত বর্ণনা করেন। কথা বলেন ছাত্ররাজনীতি, সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা, প্রেম-বিয়ে আর ভালোবাসা নিয়েও।
রাষ্ট্রপতির সেই বক্তব্যের খানিকটা এখানে তুলে ধরা হলো :
‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। ১৯৬১ সালের আমি ম্যাট্রিক পাস করছি। এবং ম্যাট্রিক থার্ড ডিভিশন। আর আইএ পাস করছি, লজিকে রেফার্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসলাম ভর্তির জন্য, ভর্তি তো দূরের কথা, ভর্তির ফরমটাও আমাকে দেওয়া হলো না। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই ভর্তি হলেন। ছাত্ররাজনীতিতে আমি ওই সময় থেকেই যুক্ত। যখন এখানে ভর্তির সুযোগ পেলাম না, তখন নিজ জেলায় দয়াল গুরুর কৃপায় গুরুদয়াল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম।
তবে ৬১ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যেহেতু আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করতাম, যার জন্য প্রায়ই ঢাকায় আসতে হতো এবং বিভিন্ন হলে রাত্রিও যাপন করতাম। সেই সময়ে এমন কোনো হল নাই যেখানে যাই নাই বা থাকি নাই। অবশ্য রোকেয়া হলে ঢুকি নাই, থাকিও নাই। ওই সুযোগ ছিল না। তবে রোকেয়া হলের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছি কম না।
বন্ধু-বান্ধব তখন কনভোকেশনের কথা বলত। আমরা কলেজে পড়লেও সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। যারা অনার্স, মাস্টার্স করত কনভোকেশনে তাদের ডাকা হতো, সুতরাং আমাদের এই কনভোকেশন ক্যাপ বা গাউন পরার কোনো সুযোগ ছিল না। যদিও মনে খুব খায়েশ ছিল। এই কাজটা পারতে ছিলাম না। কিন্তু আল্লার কী লীলা-খেলা বুঝলাম না, যে ইউনিভার্সিটিতে আমি ভর্তি হতে পারলাম না, সেই ইউনিভার্সিটিতে আমি চ্যান্সেলর হয়ে আসছি। শুধু এখানে না, যতগুলো পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে সবগুলোরই চ্যান্সেলর। প্রায় জায়গাতেই আমাকে সমাবর্তনে যেতে হয়।
এখন এই ক্যাপ আর সিনথেটিক কাপড়ের গাউন লাগিয়ে দেড়-দুই ঘণ্টা বসে থাকা বড় কঠিন। কারণ এই সিনথেটিক কাপড়ের ভেতরে কোনো বাতাস ঢুকতে পারে না। গরম যখন থাকে, তখন তো অবস্থা কাহিল। আমি সম্মানিত ভিসি সাহেবকে অনুরোধ করব, আপনাদের এই কনভোকেশন যদি শীতকালে হয়, তাহলে একটু সুবিধা হয়। কারণ, আজকে আমি এই যে অন্ধকার, এখানে বৃষ্টির ভয়ে ত্রিপল দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি আসলে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। যদি কনভোকেশন ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হতো, ত্রিপল না দেওয়া হতো, তাহলে এখানে অন্ধকার দেখা যেত না, তাহলে হয়তো সবার চেহারাটা একটু দেখা যেত। ভিসি মহোদয়কে আমি অনুরোধ করব, কনভোকেশনগুলো যেন মোটামুটি শীতকালে হয়।
আমি ছাত্ররাজনীতি করেছি। একটি ছাত্র সংগঠনের কিশোরগঞ্জ মহকুমার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও কাজ করেছি। গুরুদয়াল কলেজের আমি নির্বাচিত ভিপি ও জিএস ছিলাম। তখন ছাত্রদের সঙ্গে আমরা এত ভালো ব্যবহার করছি, যাতে ভোটে দাঁড়ালে আমাকে ভোট দেয়। ভালো ভালো ছাত্রদের আমরা আমাদের দলে ভেড়াতে চাইতাম। তারা তো রাজনীতি থেকে একটু দূরে থাকতে চায়। তারা অসুস্থ হলে ডাব-কলা নিয়ে যেতাম, সাধারণ ছাত্রদের ফরম ফিলাপ করে দিতাম, যাতে তারা আমাকে ভালোবাসে।
কিন্তু এখন কী হইছে বুঝি না। নিজের কথা আর কী বলব। সব কাজ তো অগ্রিম করে ফেলছি। ইন্টার পরীক্ষা দিয়েই বিয়ের কাম করে ফেলছি। এখন শুনি, ছাত্র সংগঠনের নেতাদের যারা বড় বড় পদে আছে, তাদের বয়স নাকি ৪৫ থেকে ৫০। আমি না হয় আর্লি করছি। ২৫-২৬ বছর বিয়ের বয়স বলা যায়। তাহলে ২৫ বছরে কেউ যদি বিয়ে করেন, তাহলে তাঁর বয়স যখন ৫০ বছর তখন তাঁর ২১-২২ বছরের ছেলেরই তো ইউনিভার্সিতে পড়ার কথা। এখন কি বাপ আর ছেলে একসঙ্গে ইউনিভার্সিতে পড়ব? বাপ ছাত্রনেতা আর ছেলে ছাত্র। এটা তো হতে পারে না। নিয়মিত ছাত্র যারা তাদেরই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা উচিত। এখন ৫০ বছরের লোক যদি ছাত্রনেতা হয়, তাহলে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তাদের অ্যাডজাস্টমেন্ট কী করে হবে? এটা আমি বুঝি না। সুতরাং ডাকসু নির্বাচন ইজ এ মাস্ট। ডাকসু নির্বাচন করা দরকার। ডাকসু নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বের জন্য একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে যাবে।
অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন, দুই বছর আগে আমাদের মাননীয় রেলমন্ত্রী বিয়ে করেছেন ৬৫ বছর বয়সে। করছে, এটাও ঠিক। তবে এটা রেয়ার কেস। সব কিছুই সময়েরটা সময়েই ভালো। অসময়ের কোনো জিনিসই ভালো হতে পারে না। আমাদের এখানে বলে, বারোমাসি কাঁঠাল, এটাও আছে। কিন্তু বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসের কাঁঠাল, এটা যে মজা লাগে আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁঠালের সেই মজা নাই। এটাও মনে রাখতে হবে।
আমার ইতিহাস অবশ্য সবই অন্যরকম। ৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করলেও ৬৫ সালে বিএ পাস করার কথা। কিন্তু সেটা পাস করলাম ৬৯ সালে। অর্থাৎ চার বছরের জায়গায় প্রায় আট বছর লেগে গেল। ছাত্র খারাপ ছিলাম এটা ঠিক। তবে শুধু ছাত্র খারাপের ব্যাপার না। দুইবার পরীক্ষার সময় জেলে ছিলাম। এটারও একটি কাহিনী আছে। যখন নাকি বিয়ে পাস করতেই পারি না, আত্মীয়-স্বজনদের চাপ। তাদেরকে উত্তর দিতে দিতে আর ভালো লাগে না। তখন আইয়ুব-মোনায়েমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতাছি। আন্দোলন তুঙ্গে। তখন কিশোরগঞ্জে স্টেডিয়ামে বিরাট এক জনসভা। সেখানেই বলে বসলাম, ভাই সব, যতদিন পর্যন্ত আইয়ুব আর মোনায়েম খানের পতন না হবে, ততদিন আমি বিয়ে পাস করতে চাই না। ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ করতালি দিয়ে আমাকে সমর্থন দিল। আমি ভাবলাম, যাক একটা সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। এরপর আর কেউ আমাকে বিএ পাস নিয়ে কোনো কথা বলেনি।
যাই হোক, গলাটা বসে গেছে। না হলে হয়তো আরো অনেক কথা বলা যেত। আমাদের সময় তো বিভিন্ন বই ঘেঁটে কোটেশন বের করে আমরা প্রেমপত্র লিখতাম। এখন তো সেটাও চলে গেছে। এখন একটা ম্যাসেজ দিলেই শেষ। প্রেমপত্র লেখাও কিন্তু একটা সাহিত্য।’