দেশের প্রথম চালের সাইলো নির্মাণের টেন্ডার চলতি বছর মার্চেই হচ্ছে। এ সাইলো নির্মাণের আনুমানিক ব্যয় ৬০ মিলিয়ন ডলার। প্রাক-যোগ্যতাসম্পন্ন ছয়টি বিদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই নির্মাণ কাজের টেন্ডারে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদফতরের আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পের পরিচালক মো. গাজীউর রহমান।
বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে গাজীউর রহমান বলেছেন, ‘আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পের আওতায় দেশে এই প্রথম চাল রাখার ছয়টি সাইলোসহ মোট ৮টি সাইলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এ যাবতকাল দেশে কোনো চালের সাইলো ছিল না। যে কয়টি সাইলো ছিল তাতে গম সংরক্ষণ করা হতো।’
তিনি জানিয়েছেন, দেশের খাদ্য সংরক্ষণে আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছিল না। স্বাধীনতার পর চালু হওয়া চট্টগ্রামের সাইলোসহ দেশের মোট চারটি সাইলোতে গম সংরক্ষণ করা হতো। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ ও সান্তাহারে অবস্থিত এই সাইলোগুলো বিজ্ঞানসম্মত হলেও আধুনিক নয়।
গাজীউর রহমান আরও বলেছেন, ‘দেশের ৬২৩টি স্থানে ২৭০০ ফ্ল্যাট গোডাউন থাকলেও তা আধুনিক নয়। এসব গুদামে চাল-গম রাখলে তা ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যেই পোঁকায় ধরে। আমনের চাল ঢোকালে বোরো ওঠার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া বাইরের তাপ এবং আর্দ্রতার মাত্রাও বেশি থাকায় খাদ্য সংরক্ষণে হিমশিম খেতে হয়। তাই নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যহানীর ঝুঁকি থাকে বেশি। এই গোডাউনের খাদ্য জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ওপরও প্রভাব ফেলে থাকে। সাইলোতে খাদ্য ৩ বছর ধরে রাখা সম্ভব।’
তার মতে, ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরপদ খাদ্যের নিশ্চয়তায় সাইলো সিস্টেম আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক। সাধারণত কংক্রিট ও স্টিলের সাইলো নির্মাণ করা হয়ে থাকে। কংক্রিটের সাইলো ১০০ বছর এবং স্টিলের সাইলো ৪০ বছর ধরে নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে যে ৮টি সাইলো নির্মাণ করা হচ্ছে তা হবে স্টিলের। এর মধ্যে ছয়টিতে চাল এবং দু’টিতে গম রাখা হবে।’
গাজীউর রহমান জানিয়েছেন, আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য চালের ছয়টিসহ মোট আটটি সাইলোর মধ্যে তিনটি স্থানে (ময়মনসিংহ, মধুপুর ও মহেশ্বরপাশা) ৬১টি বিনের প্রায় ২০৬ মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতার মূল সাইলো নির্মাণ কাজের টেন্ডার হবে। তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত সাইলো নির্মাণ কাজের জন্য প্রাকযোগ্যতা সম্পন্ন মোট সাতটি বিদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ডব্লিউ-৩ এর টেন্ডার চলতি মাসেই (মার্চে) হবে। এতে চীনের ৪টি, জার্মানির ১টি ও দক্ষিণ কোরিয়ার ১টি কোম্পানি অংশ নেবে। পরে ডব্লিউ-২ এবং ডব্লিউ-১ ফেজের মূল সাইলো নির্মাণের টেন্ডার করা হবে। ডব্লিউ-২’তে চট্টগ্রাম ও খুলনার এবং ডব্লিউ-১’তে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের সাইলো নির্মাণের কাজ করা হবে।
তিনি বলেছেন, “দুর্যোগ পরবর্তী জরুরি প্রয়োজনে সরকারি এবং পারিবারিক পর্যায়ে কার্যকর মজুদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য নিয়েই ‘আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্প’ নেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ১১ মার্চ প্রকল্পটি একনেকের সভায় অনুমোদন পায়। ওই বছরেই ৮ এপ্রিল পরিকল্পনা কমিশন ও ৫ মে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জিও (সরকারি আদেশ) পায়। ১৯২০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার অর্থসহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে আইডিএ ক্রেডিট ১৯১৬ কোটি ৬৫ লাখ ও জিওবি ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রয়েছে। জিওবির টাকায় এই প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হবে। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল প্রকল্পটির আর্থিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ বছরের ৬ আগস্ট প্রকল্প পরিচালক যোগ দেন।’
গাজীউর রহমান আরও বলেছেন, ‘প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে-মজুদ বাড়াতে ৫,৩৫,৫০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ৮টি আধুনিক সাইলো নির্মাণ, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় খাদ্যশস্য/বীজ সংরক্ষণের জন্য পারিবারিক পর্যায়ে ৭০ লিটার ধারণ ক্ষমতার ৫ লক্ষ পারিবারিক সাইলো বিতরণ, বন্যা-সাইক্লোন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় খাদ্যশস্যের নিরাপদ মজুদ নিশ্চিত করা, খাদ্যশস্যের গুণগতমান এবং পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত প্রযুক্তির অভিযোজন, পরিমাণ ও গুণগত মজুদ ঘাটতি হ্রাস করা, খাদ্য মজুদ, চলাচল, সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাপনা উন্নত করা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা কাজ পরিচালনা এবং ফলাফল বাস্তবায়ন করা।’
তিনি জানিয়েছেন, মোট ২৯ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই প্রকল্পে কর্মরত রয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৮টি সাইলো নির্মাণের সাইট সিলেকশন, নদী শাসন (নদীর তীর সংরক্ষণ ইত্যাদি), ভূমি উন্নয়নকাজসহ আনুসঙ্গিক কাজের ৯০ ভাগ শেষ হযেছে। নির্ধারিত সময়ের (২০২০ সালের জুনেই) মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যায়।
এদিকে, এ প্রকল্পের ডব্লিউ-৩ ফেজের ময়মনসিংহ, মধুপুর ও মহেশ্বরপাশায় সাইলো নির্মাণে মোট ৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রকিওরমেন্ট স্পেশালিস্ট (ক্রয় বিশেষজ্ঞ) সৈয়দ রফিকুল আলম।
প্রকল্পের সিনিয়র সোশ্যাল স্পেশালিস্ট মো. মনিরুজামান বলেছেন, ‘প্রকল্প এলাকা চট্টগ্রাম ও খুলনার মহেশ্বরপাশায় বসবাসরত ৩৯ জনকে পুনর্বাসনের জন্য মোট ১২ লক্ষ ৫০ হাজার ৯৭৭ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে ভোলা জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক অনন্ত কুমার বিশ্বাস দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘জমি সংক্রান্ত সমস্যায় বরিশালে সাইলো নির্মাণ করা যাচ্ছে না।’
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘হাইকোর্টে মামলার কারণে নতুন করে সাইট বাছাই করে বরিশাল শহরে খাদ্য বিভাগের ১৩টি পুরনো গোডাউন ভেঙে সেখানে এই সাইলো নির্মাণ করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে দেশের সব গোডাউন এলাকায় সাইলো গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে এই সরকারের।’