শিল্প উন্নয়শীল দেশগুলোর নজড় এখন বাংলাদেশের পায়রা সমুদ্র বন্দরের দিকে। পায়রাবন্দর বর্তমানে বানাবাদ চ্যানেল থেকে সরাসরি পন্য খালসের মধ্যদিয়ে স্বল্প খরচে দ্রুত সময়ের মধ্যে পন্য আমদানী এবং রপ্তানীতে সক্ষমতা অজর্ণ করেছে। ভৌগলীক অবস্থানের দিক থেকে এটি সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।
তবে ইতোমধ্যে পায়রা সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কাস্টম হাউজ ২০১৬ থেকে চার অর্থ বছরে ১০৮ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় করেছে পন্য নিয়ে আসা ৫৪টি জাহাজ থেকে। পায়রাবন্দর প্রকল্পটি সরকারের ‘ফাস্ট ট্রা প্রকল্প’ হওয়ায় দ্রুত এর নির্মান কাজ এগিয়ে চলছে। পায়রা বন্দর পূর্ণাঙ্গতা রূপদানে চলছে নির্মান কাজ অপরদিকে চলছে পন্য আমদানী বা খালাসের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়।
পদ্মা সেতুসহ পায়রাবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার লেবুখালী ব্রিজ এবং রেল চলাচল শুরু হলে পায়রা বন্দর হবে একটি ব্যস্ততম এবং লাভ জনক বন্দর; এমনটি মনে করছেন পদ্মার দক্ষিন পাড়ের ব্যবসয়িরা। এমনকি পায়রা বন্দরের পর্ণাঙ্গতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে কলাপাড়াকে অর্থনৈতিক অর্থনৈদিত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এক কথায় পায়রা বন্দরকে ঘিরে চলছে কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকার সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড।
বর্তমানে চলছে পায়রা বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মান এবং বন্দরের জেটিসহ ভাড়ি যন্ত্রাংশ স্থাপনের মাধ্যমে চলছে পন্য খালাস কার্যক্রম। একই সঙ্গে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের টার্মিনাল ব্যবহার করে আমদানীকৃত কয়লা খালাসে সহায়তা করছেন পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ।
পায়রা বন্দরকে ঘিরে কলাপাড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিমান বন্দর, ঢাকা হতে পায়রা পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপন, ডকইয়ার্ড ও শীপ ইয়ার্ড, ইকোট্যুরিজম, এলএনজি টার্মিনাল, লিক্যুইড বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণসহ অন্যান্য সুবিধা ও অবকাঠামো গড়ে গড়ে তোলার কাজ চলবে বলে ইতোপূর্বে সাংবাদিক সম্মেলনে নিশ্চিত করেছেন পায়রা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর মো. জাহাঙ্গীর আলম ।
পায়রা বন্দর কাস্টম হাউজ কর্মকর্তাদের সূত্রে জানাগেছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে পায়রা বন্দরে ১০ টি জাহাজ যোগে পন্য নিয়ে আসে। এখান থেকে ১৮ কোটি ৮১ লাখ, ৪০ হাজার ৬৩১ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১০ টি জাহাজ যোগে পন্য নিয়ে আসে।
এখান থেকে রাজস্ব আয় হয় ২০ কোটি ৯৩ লাখ, ৯৬ হাজার ৮৮২ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১১ টি জাহাজ যোগে পন্য নিয়ে আসায় রাজস্ব আয় হয় ৩১ কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৮১ টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থ বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ২৩টি জাহাজ পন্য খালাস করেছে পায়রা বন্দর থেকে। এখান থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ২১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৫৫ টাকা। বর্তমানে পায়রা বন্দর থেকে নির্মানাধিন পদ্মা সেতু, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন র্শীষ পর্যায়ের বাণিজ্যিকি প্রতিষ্ঠান পন্য আমদানী করছেন।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানাগেছে, সরকারের ‘ফাস্ট ট্রা প্রকল্প’ এর আওতায় পায়রা বন্দরের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে ১৯টি মপপোনেন্টে বিভাজন করা হয়। এর মধ্যে ১২টি কমপোনেন্ট পায়া বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরকারি ও অন্যান্য দেশের (জিটুজি) অর্থায়নে এবং সরকারি -বেসরকারি অংশদিদারিত্ব (পিপিপি) এর ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে এবং অপর সাতটি কমপোনেন্ট স্ব স্ব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত হবে। পায়রা বন্দরকে পরিকল্পিত এবং একবিংশ শতাব্দী উপযোগি একটি আন্তজাতিক মানের সমুদ্র বন্দও হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য এর সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডকে সরকার স্বল্প মেয়াদে, মধ্য মেয়াদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে এই তিনটি ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহন করেছে।
স্বল্প মেয়াদে বন্দরের কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বন্দরের টিয়াখালীর ইটবাড়িয়া গ্রামের আন্ধারমানিক নদেও তীরে নিরাপত্তা ভবন নির্মান কাজ, নিরাপদ পানি শোধনাগার, ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সাব স্টেশন। উচ্চ তরঙ্গ সম্পন্ন ইকুইপমেন্টসহ ভিএইচএফ টাওয়ার, প্রশাসনিক ভবন, টাওয়ার হাউজ, মসজিদ, মাল্টিপারপাস ভবন, স্টাফ ডরমেটরি, সার্ভিস জেটি নির্মান এবং সংযোগ নদী খনন, নদীতে বয়া স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়া বন্দর পরিচালনার কাজে নিয়োজিত জলযান-পাইলট ভ্যাসেল, হেভি ডিউটি স্পিড বোট, টাগবোট, বয়লেইং ভ্যাসেল এবং জড়িপ বোট নির্মান শেষ পর্যায় রয়েছে। ডিটেইল মাস্টার প্ল্যান ও অন্যান্য ডকুমেন্টস প্রস্তুতির জন্য বুয়েট ও নেদারল্যান্ডভিত্তিক রয়েল হাসকিং ডিএইচভি কে পরামর্শক নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়েছে।
জাতীয় মহাসড়কের সাথে স্থল সংযোগের জন্য চার লেন বিশিষ্ট ‘শেখ হাসিনা’ সড়কের নির্মান কাজ শেষ পর্যায় রয়েছে। সে লক্ষ্যে মহাসড়কের রজপাড়া থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত পাঁচ দশমিক ৬০ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা ২৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মিত হচ্ছে। রাস্তার প্রসস্ত হবে ২৩ দশমিক ২৯ মিটার। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এমবিইএল, ঢাকা এর অধিনে ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে সড়ক নির্মান কাজ শুরু করে।
পায়রা নির্মানে ক্ষতিগ্রস্থ জনগনের পুনরবাসনের জন্য নির্মিত পায়র বন্দর নিকটস্থ এলাকায় ছয় হাজার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহন কার্ডক্রম চলমান রয়েছে। জমি ধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ তিন হাজার ৫০০ পবিারের আনুসাঙ্গীক সুবিধাসহ গৃহ নির্মান (আবাসন) চলমান রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের চার হাজার ২০০ নারী-পুররুষকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য ১৫৫টি কোর্সে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। পায়রা বন্দডিজেইল মাস্টার প্লান ও অন্যান্য ডুকমেন্টস প্রস্তুতির লক্ষ্যে বিআরটিসি, বুয়েট ও নেদারল্যান্ড ভিত্তিক রয়াল হাসকোনিং ডিএইভি এর সাথে গত চলতি বরের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ি কার্যক্রম চলছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর মো. জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদর জানায়, বর্তমানে পায়রা বন্দর কাস্টম হাউজ ২০১৬ থেকে চার অর্থ বছরে ১০৮ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় করেছে এবং পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের আয় হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা।
পায়রা বন্দও হতে খালাসকৃত মালামাল দেশের অভ্যন্তরীন পরিবহনের লক্ষ্যে রাবনাবাদ চ্যানেল সংলগ্ন এলাকায় নূন্যতম অবকাঠামো সংযোগ সড়ক, আন্ধারমানি নদেও ওপর সেতু নির্মান এবং ৬৫০ মিটার দৈঘ্যের জেটিসহ একটি টার্মিনাল নির্মানের লক্ষ্য পায়রা বন্দরের প্রথম চার্মিনাল প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ০৪ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি স্থাপনা সমূহের ডিটেইল ড্রইং, ডিজাইন, ডুকমেন্টেশন এবং প্রকল্প চলাকালীন টপ সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক সেবা গ্রহনের লক্ষ্যে চলতি বরের গত ২৩ এপ্রিল তারিখ কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা সাড়ে দশ মিটার উন্নীতের লক্ষ্যে ‘ক্যাপিটাল এন্ড মেইনটিন্যান্স ড্রেজিং’ প্রকল্পটি জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প অথবা ন্যাশনাল প্রারইটি প্রকল্প (এনপিপি) হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে গত ১৪ জানুয়ারি বেলজিয়াম ভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানী ‘জান ডি নুল’ এর সাথে ড্রেজিং প্রকল্পটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।যেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় আট হাজার ২৯৭ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজটি ২০২২ সাল নাগাদ শেষ করা সম্ভব হবে বলে নিশ্চিত করেছে পায়রা কর্তৃপক্ষ।
ভারত সরকারের লাইন অব ক্যাডিট-৩ (এলওসি-৩) এর আওতায় আভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়ক ও এক হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জেটিসহ একটি টার্মিনাল নির্মানের লক্ষ্যে পায়রা বন্দরের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মান প্রকল্পটির প্রাথমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় আট হাজার ২৯৭ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা। পিপিপি এর অর্থায়নে ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জেটি ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মানের লক্ষ্যে ড্রাইবাল্ক/কোল্ড টার্মিনাল নির্মান (প্রথম পর্যায়) একটি প্রকল্প প্রস্তাবের কাজ চলমান রয়েছে।
এছাড়া পায়রা বন্দরের অভন্তরীণ সংযোগ সড়ক ও ১২০০ মিটারের দীর্ঘ জেটিসহ টার্মিনাল নির্মাণে পাঁচ হাজার এক শ’ ৫০ কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় সংবলিত “পায়রা বন্দরের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ” শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করেছে। এছাড়া ২১২৫ কোটি টাকা ব্যয় ড্রাই বাল্ক/কোল টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প চুড়ান্ত করা হয়েছে। সামগ্রীক ভাবে পায়রা বন্দরটি ২০২৫ সালে একটি পুর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হতে যাচ্ছে । ইতোমধ্যে পায়রা বন্দর নির্মান কাজকে ঘিরে পাল্টে যেতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র।