কি অদ্ভুত মিল! যে দিনে মিলেছিল প্রথম ওয়ানডে জয়ের দেখা, ২১ বছর পর ঠিক সেই ১৭ মে’তেই প্রথম শিরোপা জয় টাইগারদের। কি গোলমেলে ঠেকছে? নাহ, তা ঠেকবে কেন?
একদম সহজ হিসেব। ইতিহাস জানাচ্ছে ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে খেলা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। আর তারও প্রায় একযুগ পর ১৯৯৮ সালের ১৭ মে ভারতের হায়দরাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে কেনিয়ার বিপক্ষে ৬ উইকেটের প্রথম জয়টিও ছিল এই ১৭ মে তারিখে, মানে কালকের দিনে।
একই দিনে প্রথম ওয়ানডে জয় আর তার ২১ বছর পর কোন ওয়ানডে টুর্নামেন্ট বা তিন জাতি আসরের ট্রফি বিজয়! রীতিমত কাকতালীয়, অতিকাকতালীয়। আরও একটি সাযুজ্য কিন্তু আছে।
তা হলো, প্রধান চালিকাশক্তি, বিপদে, প্রয়োজনে ও দরকারে যাদের কার্যকর পারফরম্যান্স টিম বাংলাদেশের প্রাণশক্তি, আশা ভরসা- সেই পঞ্চপান্ডব কিন্তু প্রথম ট্রফি জয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেননি বা রাখতে পারেনি। তাদের বদলে প্রথম ট্রফি জয়ের নায়ক, মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ফাইনালে টাইগারদের জয়ের রুপকার ও নায়ক- দুজন তরুণ; সৌম্য সরকার আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত।
একই ভাবে ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়ের ম্যাচেও তখনকার তিন সুপার স্টার ও প্রধান স্তম্ভ আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু আর আমিনুল ইসলাম বুলবুলের কেউ নায়ক নন। এই তিনজনের বাইরে আর যাদের ধরা হতো ফ্রন্টলাইন পারফরমার- সেই আতহার আলী, এনামুল হক মনি আর খালেদ মাহমুদ সুজনও কিন্তু প্রথম জয়ের রূপকার হতে পারেননি।
তাদের সবাইকে টপকে কেনিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৮ সালে হায়দরাবাদে টিম বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক মোহাম্মদ রফিক। এটুকু শুনে ভাবছেন, সে কি কথা? রফিক তো ‘চ্যাম্পিয়ন’ পারফরমার ছিলেন। ঐ অসাধারন মেধাবী বাঁহাতি স্পিনারও তো ম্যাচ উইনারই। তার বোলিং কার্যকরিতাও প্রমাণিত।
তা অবশ্যই। রফিক বল হাতে কেনিয়ানদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে ম্যাচ জেতালে, কোন কথাই ছিল না। তিনি সে সামর্থ্য রাখতেন। কেনিয়া কেন, তার বল খেলতে অনেক প্রতিষ্ঠিত শক্তির বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানেরও কষ্ট হয়েছে। রফিক পর্যাপ্ত সমীহ আদায়ের পাশাপাশি রাজ্যের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
কিন্তু শুনে অবাক হতে পারেন, আর যাদের রেকর্ড-পরিসংখ্যান মুখস্ত বা আত্মস্থ, তারা জানতে পারেন, মোহাম্মদ রফিক বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক হয়েছিলেন বোলিংয়ের কারণে নয়, নিজের উত্তাল ব্যাটিং দিয়ে।
সেদিন বল হাতে ৫৬ রানে তিন উইকেট দখল করা রফিক ব্যাট হাতে ইনিংসের ওপেন করতে নেমে খেলে ফেলেন ৮৭ বলে ৭৭ রানের ঝলমলে ও আক্রমনত্মক ইনিংস। তার বাঁহাতের চটকদার ও ঝড়ো উইলোবাজির মুখেই খড়কুটোর মত উড়ে যায় কেনিয়ান বোলিং। কেনিয়ার ২৩৬ রান টপকে খেলার ১২ বল বাকি থাককে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। ম্যাচ জেতানো ব্যাটিংয়ের জন্য রফিক হন ম্যাচসেরা।
কাল প্রথম ট্রফি জয়ের মিশনেও ঠিক তেমনিভাবে তামিম, সৌম্য, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মিঠুন ও সাব্বিরকে পিছনে ফেলে নায়ক মোসাদ্দেক। এতকাল জানা ছিল ‘পঞ্চপান্ডব’ই সব।
গত পাঁচ বছর বিশেষ করে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগে থেকে এই আয়ারল্যান্ডের তিন জাতি আসরের ফাইনালের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সব ওয়ানডে জয়ের পিছনে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহর অবদান সর্বোচ্চ। প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে তারাই সাফল্যের রূপকার, স্থপতি এবং জয়ের নায়ক। প্রতিপক্ষর সাথে লড়াই করে ব্যাট ও বল হাতে সাফল্যের ভিত রচনা এবং সাফল্যের বন্দরে পৌঁছে দেয়া- সব কাজেই পঞ্চপান্ডব অগ্রণী ভূমিকায়।
কাল (শুক্রবার) ১৭ মে শুক্রবার ডাবলিনের মালহিডের ‘দ্যা ভিলেজ’ মাঠে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। এই ম্যাচে টাইগারদের জয়ের দুই মূল রূপকার ও প্রধান নায়ক পঞ্চপান্ডবের কেউ নন। দুই তরুণ তুর্কি সৌম্য সরকার আর মোসাদ্দেক হোসেন।
এমন নয়, আর কারো কোনো অবদান নেই। শুধু বাঁহাতি ওপেনার সৌম্য আর লেট মিডলঅর্ডার মোসাদ্দেকই দল জিতিয়েছেন। আর কেউ কোন ভূমিকা রাখেননি, তা বলা যাবে না। ২৪ ওভারে ২১০ রানের কঠিন লক্ষ্যে পৌছাতে পঞ্চপান্ডবের দুজন তামিম আর মুশফিকও অবদান রেখেছেন।
লক্ষটা সহজ ছিল না মোটেই। ওভারপ্রতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮.৭৫ রান। সবার আগে প্রয়োজন ছিল উড়ন্ত সূচনার। সৌম্যর ঝড়ো উইলোবাজির সাথে তামিম (১৩ বলে ১৮) রানের সাপোর্ট দিলে প্রথম ৫.৩ ওভারে উদ্বোধনী জুটিতে সেই শুরু (৫৯ রান) পায় বাংলাদেশ।
আর শেষ দিকে সৌম্য, মুশফিক, সাব্বির আর মিঠুন আউট হবার পর একদিক আগলে রাখাটাও ছিল জরুরী। অভিজ্ঞ আর পঞ্চপান্ডবের অন্যতম সদস্য মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (২১ বলে ১৯) সে দরকারি কাজটিও করেছেন।
তবে শুরুর ঝড় বইয়ে ক্যারিবীয় বোলিংকে লন্ডভন্ড করার কাজটি সেড়েছেন সৌম্য। তার ১৬০.৯৭ স্ট্রাইকরেটে ৪১ বলে ৬৬ রানের ঝড়ো ইনিংসটি তাই বাংলাদেশকে আশা জাগিয়েছে। জয়ের পথে অনেকদূর এগিয়েও দিয়েছে।
আর শেষ দিকে ২১৬.৬৬ স্ট্রাইকরেটে মাত্র ২৪ বলে ৫২ রানের উত্তাল ইনিংস (পাঁচটি ছক্কা ও দুটি বাউন্ডারি) খেলে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে রাজ্যজয়ী নাবিকের মত শেষ হাসি হেসেছেন তরুণ মোসাদ্দেক।
শেষ ২৪ বলে যখন ৩৯ রান দরকার, ঠিক তখনই বিদ্যুতের মত ঝলক খেললো মোসাদ্দেকের ব্যাট। ২১ নম্বর ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্টবোলার কেমার রোচকে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে তুলে মেরে ছক্কা হাঁকানোটাই প্রথম আক্রমনাত্মক শট।
সে ওভারে ১২ রান আসার পর রীতিমত আগ্রাসী মূর্তি মোসাদ্দেকের। ২২ নম্বর ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলার ফ্যাবিয়ান অ্যালেনের ওপর প্রবল বেগে আক্রমণ। তিন ছক্কা আর এক বাউন্ডারি হাঁকানোসহ ২৫ রান তুলে একদম হিসেব সহজ করে ফেলেন মোসাদ্দেক। আর তখনই জয় হাতের মুঠোয় এসে যায় টাইগারদের।