উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন এ বছরের অক্টোবর মাসে হতে পারে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বছরের শেষের দিকে সম্মেলনের ব্যাপারে তার সম্মতি দিয়েছেন। রোজা, ঈদ ও পঞ্চম ধাপে উপজেলা নির্বাচনের পর সারা দেশে উপজেলা ও জেলা কমিটি গঠন হবে। কমিটিগুলো থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরা জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব বেছে নেবেন।
আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদ ঘিরেই নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভেতর থাকে মূল আগ্রহ। আসছে কাউন্সিলেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে নানা জল্পনা। ইতিহাস ঘেঁটে চেষ্টা চলছে সমীকরণ মেলানোর। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতা এ গুঞ্জনকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও দলটির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। ৭০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় এ পর্যন্ত দলটির ২০টি সম্মেলন হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদায়ী আওয়ামী লীগে চারবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই বা এর বেশিবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। দলটির ইতিহাসে আবদুল জলিল একবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর ২০তম সম্মেলন হয় আওয়ামী লীগের।
ওই সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয় যার সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ওই কমিটির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জে উতরে যাওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে যে ইশতেহার ঘোষণা করে তার আলোকেই নতুন নেতৃত্ব গড়তে ২১তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ইশতেহারে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনা ও তারুণ্যেও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নেওয়া হয়। ২০২১ সাল স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও ২০২০ সাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এ দুটি মাইলফলক ধরে পরপর তিনবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ রূপকল্প-২০২১ সফলভাবে সম্পন্ন করতে চায়। এ লক্ষ্য নিয়েই নতুন কমিটি গড়তে চায় আওয়ামী লীগ যেখানে তারুণ্যের প্রাধান্য থাকবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৩ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে হার্ট অ্যাটাক হলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার হৃৎযন্ত্রে ব্লক পান। চিকিৎসকদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় বড় ধরনের শঙ্কা থেকে রক্ষা পেলেও পর দিনই তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও চিকিৎসকদের ফলোআপে থাকতে হচ্ছে তাকে। এ মাসেই তার দেশে ফেরার কথা।
দেশে ফিরলেও ৬৭ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদের এ মুহূর্তে দল ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পুরোদমে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বলা হচ্ছে, তার পুরোপুরি সেরে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, ভালোভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যই ওবায়দুল কাদেরের বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া তার মন্ত্রণালয় ব্যস্ততম মন্ত্রণালয়গুলোর একটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন বছরে আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের পরিকল্পনা তা সুসম্পন্ন করার জন্য সভাপতির আস্থাভাজন, ডায়নামিক ও নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সাধারণ সম্পাদক প্রয়োজন। গত কয়েকটি সম্মেলনে সভাপতিম-লীর সদস্য ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ২০০২ সালের কাউন্সিলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০০৯ সালের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের কাউন্সিলে তাকে পুনঃনির্বাচিত করা হয়। ওই কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরকে ২০১৬ সালের সর্বশেষ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
আসছে কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমানকে নিয়ে জল্পনা চলছে। এ ছাড়া নতুন নেতৃত্বের চমক হিসাবে বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিমকেও এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ।
সাধারণ সম্পাদক পদে সম্ভাব্য যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রাজ্জাক ও দীপু মনি বর্তমান সংসদের এমপি। জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আবদুর রহমান, বি এম মোজাম্মেল হক ও এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিমকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে তাদের চারজনকেই নির্বাচনী পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনেই গড়ে ৩০ ভাগ নতুন মুখ আসছে। জাতীয় সম্মেলনেও নেতৃত্বে অনেক নতুন মুখ আসবে। ভবিষ্যৎ দলের কথা বিবেচনা করেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দেওয়া হচ্ছে।’
সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে গুঞ্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘কোনো গুঞ্জনেই কাজ হবে না। দলীয় সভাপতি ছাড়া আর কেউ জানেন না সাধারণ সম্পাদক কে হবেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররাও এ দায়িত্ব নেত্রীকে দেন। নেত্রী যাকে ভালো মনে করবেন তাকেই দলের সাধারণ সম্পাদক বানাবেন।’
সূত্র বলছে, দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য রাখতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত কয়েক বছরে বারবার তিনি নতুন নেতৃত্বের কথা বলেছেন। দলকে শক্তিশালী করা, তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে আরও বিস্তৃত করা, স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য গতিশীল সংগঠন গড়ে তুলতে চান তিনি। দেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্যও সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম এমন নেতৃত্বের হাতেই তুলে দিতে চান দলের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ২১তম জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে চমক থাকবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঈদের পর পঞ্চম ধাপে উপজেলা নির্বাচন শেষ হলে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কাউন্সিল শেষ করতে তোড়জোড় শুরু হবে। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই দলের পরবর্তী নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার জন্য কাউন্সিলররা প্রস্তুত হবেন। অক্টোবরেই হতে পারে সম্মেলন।