আগুনে পুড়ে যাওয়া চার তলা রাজ্জাক ভবনের সামনে উদ্ধারকর্মী, সাংবাদিক ও কৌতূহলী মানুষের জটলা। স্বেচ্ছাসেবকেরা মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। তারা দড়ি দিয়ে রাস্তার এক জায়গায় দর্শনার্থীদের আটকে দিয়েছেন। সেই বৃত্তের বাইরে রাস্তার পাশে নাসরিন নামে এক তরুণী বাবার ছবি হাতে নিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছিলেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, গতকাল রাত থেকে তাঁর বাবা জয়নাল আবেদিন বাবুলকে খুঁজছেন। পাশেই তাঁদের বাসা। রাত ১০টার দিকে তিনি চা খেতে এসেছিলেন চকবাজারের চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে।
যেই ওয়াহেদ ম্যানসন নামের যে ভবন বুধবার রাতে পুড়ে গেছে, তার নিচ তলার একাংশে একটি রেস্তোরা ছিল, আরেক অংশে প্লাস্টিকের গুদাম। দোতলা, তিনতলায়ও পাশাপাশি গুদাম ও বসতবাড়ি। সেই গুদামে ছিল কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, স্প্রের কৌটা। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু রাজ্জাক ভবন নয়, রাস্তার ওপাশের নিচ তলায় যারা ছিলেন, তারাও পুড়ে মরেছেন। কিন্তু নাসরিন মৃতদের তালিকায় তাঁর বাবাকে খুঁজে পাননি।
কীভাবে আগুন লাগল— গাড়িতে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার না রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার থেকে তা নিয়ে তখন উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বিতর্ক চলছিল। প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেল না। সবাই বলছেন, ঘটনার পর এসেছেন। কেউ বা সকালে এসে ধ্বংসস্তূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। পুড়ে যাওয়া রাজ্জাক ভবনের চার তলা থেকে তখনো হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন তখনো উদ্ধার কাজে ব্যস্ত। রাস্তায় লোকজনের হই চই। সাংবাদিকদের ছুটোছুটি।
কিন্তু নাসরিন রাস্তার এক পাশে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, আর হাতের ছবিটি সবাইকে দেখাচ্ছেন। আগুন লাগার পর যখন বাবা ঘরে ফিরছিলেন না, তখনই নাসরিন ও তাঁর বোন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন।তখন অগ্নিদগ্ধ ভবনের পাশে যাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁরা ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল। প্রত্যকটি লাশ তাঁরা দেখেছেন। আহতদের মধ্যেও বাবাকে খুঁজেছেন। কোথাও বাবাকে পাননি।
নাসরিনের আকুতি, বাবা মারা গেলেও তাঁর লাশটি তো থাকবে। কিন্তু উদ্ধারকর্মী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউ তাঁর বাবা জয়নুল আবেদিন বাবুলের খোঁজ দিতে পারেননি। হাসপাতালের মর্গে যেসব লাশ আছে, বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য যেসব আহত রোগী ভর্তি হয়েছেন, তার মধ্যে কোথাও জয়নুল আবেদিন বাবুলের নাম নেই।
নাসরিনের চোখ থেকে তখন অঝোরে পানি পড়ছিল। কথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর পাশেই ছিলেন অলক কুমার সরকার নামে এক ভদ্রলোক। তিনি বললেন, জয়নুল আবেদিন বাবুল তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাতে আগুন লাগার ঘটনার পর থেকে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও কেউ খোঁজ দিতে পারছেন না। মানুষটি মারা গেলেও তো তাঁর লাশ থাকবে।
শুধু জয়নুল আবেদিন নয়, হতাহত আরও অনেকের স্বজনেরা এখানে এসেছেন। বাবার খোঁজে ছেলে বা মেয়ে এসেছেন। সন্তানের খোঁজ মা এসেছেন। তাঁদের এই খোঁজের শেষ কোথায়?