আমাজনের দ্বিতীয় সদর দপ্তর নিউইয়র্ক নগরীতে হচ্ছে না। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে এ নতুন সদর দপ্তর স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু তীব্র আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে এ টেকজায়ান্ট কোম্পানি। ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাজনের মুখপাত্র জোদি শেইথ দুপুরে এ তথ্য জানিয়েছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি আমাজন বলেছে, নিউইয়র্ক নগরীতে একটি করপোরেট ক্যাম্পাস নির্মাণের যে পরিকল্পনা ছিল, তা বাতিল করা হচ্ছে। কুইন্সের লং আইল্যান্ড সিটিতে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে একটি বিস্তৃত কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় আইন প্রণেতাদের কাছ থেকে এ সম্পর্কিত চুক্তিটি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এ অবস্থায় চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাজন।
নিউইয়র্কে আমাজনের সদর দপ্তর স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, জনগণের আন্দোলনের কাছে পুঁজিবাদের বড় প্রতিনিধি আমাজনের এ পিছু হটায় তাঁরা খুশি হয়েছেন। এই সদর দপ্তর স্থাপনের চুক্তি নিয়ে মূল সমালোচনাটি ছিল আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে।
আমাজনের এ সিদ্ধান্ত নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ও মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর জন্য বড় আঘাত। নিউইয়র্কে আমাজনকে আনার মূল উদ্যোগই ছিল এই দুজনের। কিন্তু আমাজন নিউইয়র্কে এলে ক্রমবর্ধমান বাসা ভাড়া ও গণপরিবহনের ওপর চাপ পড়বে—এমন বিবেচনায় স্থানীয় আইন প্রণেতারা এর বিরোধিতা শুরু করেন।
মূলত মানবাধিকারকর্মীরাই এই আন্দোলনের সূচনা করেন, যা সবখানে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। শহরবাসী, বিশেষত লং আইল্যান্ড সিটির আশপাশের এলাকার অধিবাসীরাই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। প্রতিবাদের কারণ ছিল, নিউইয়র্ক নগরীর বাসা ভাড়া ক্রমাগত বাড়ছে। বাড়ি ভাড়ার এই ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতেই মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় আমাজনের ২৫ হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য মিলে দুই লাখ মানুষ একই সঙ্গে শহরে ঢুকলে সেই ভাড়া বেড়ে যাবে বহু গুনে। বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা আরও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। বাড়বে যানজট। এ ছাড়া অভিবাসন পুলিশ যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবৈধ অভিবাসীদের আটক করে, তার সরবরাহদাতাও আমাজন। অভিবাসীবান্ধব নিউইয়র্ক নগরীতে আমাজনের এই প্রবেশ অভিবাসীদের মধ্যে শঙ্কা বাড়িয়ে দেবে। কারণ আমাজনের প্রধান কেন্দ্র যদি হয় খোদ নিউইয়র্ক, তাহলে এ ধরনের ধরপাকড় আরও বাড়বে।
আন্দোলনকারীদের মতে, আমাজনের ৩৬০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে কুইন্স বরোর লং আইল্যান্ড সিটি ও তার আশপাশের এলাকা ও এর অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষত অ্যাস্টোরিয়া, সানিসাইড, উডসাইড, জ্যাকসন হাইটস, এলমহার্স্ট এলাকার জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নিউইয়র্কে সদর দপ্তর স্থাপনের ঘোষণা আসার পর থেকেই তাই আন্দোলন শুরু হয়। ম্যানহাটনে আমাজন স্টোরের সামনে আন্দোলনকারীরা মেয়র ও গভর্নরের বিরুদ্ধে টানা স্লোগান দেন। তাঁদের দাবি, আবাসন কোম্পানিগুলো গত মেয়র ও গভর্নর নির্বাচনের সময় অ্যান্ড্রু কুমো ও বিল ডি ব্লাজিওর পেছনে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আমাজন নিউইয়র্কে এলে বাসা ভাড়ায় যে উল্লম্ফন হবে, তা দিয়েই তারা মুনাফা তুলে নেবে—এই পরিকল্পনা থেকেই তারা দুই রাজনীতিকের পেছনে এত বড় বিনিয়োগ করেছিল। আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে সামনের কাতারে ছিল ড্রাম, এলাইন, রিটেইল অ্যাকশন প্রোজেক্ট, রিটেইল অ্যাকশন ইউনিয়ন, মেক দ্য রোড ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরাট বাহিনী।
এ বিষয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ড্রামের মানবাধিকার কর্মী কাজী ফওজিয়া বলেন, নিউইয়র্ক নগরীর অনেক স্কুল যেখানে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো স্কুল ঠিকভাবে শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে না, তারা কেন আমাজনের আগামী পাঁচ বছরের কর মওকুফ করে দিচ্ছে—এটা আমার মাথায় আসেনি। নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।’ এর আগে সিয়াটলের মানুষ আন্দোলন করে আমাজনকে তাড়িয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শ্রমজীবী ও সাধারণ নিউইয়র্কারদের এ বিজয় আমাদের জন্য উৎসাহের কারণ। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে পুঁজির পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যারা দম্ভ করে, তাদেরও পিছু হঠতে হয়। এ বিজয় আন্দোলনকারীদের, এ বিজয় জনতার।’
কাজী ফওজিয়া বলেন, ‘আমাজনের সিলিকন ভ্যালির অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। ফেসবুক, গুগল ও আমাজনের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করতে চেয়েছিল সান ফ্রান্সেসকোর ওই এলাকায়। তখন স্থানীয়রা ঘর বাড়ির ভাড়া অনেক বেড়ে যাওয়ায় এলাকা ত্যাগ করেন। এমনকি অনেক আমাজন কর্মী বাড়ি ভাড়া করতে না পেরে গাড়িতে রাতে ঘুমায়। এখন নিউইয়র্কেও এটাই ঘটবে।’
টানা বিক্ষোভের সময় আন্দোলনকারীরা মেয়র ও গভর্নরকে গণশত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর মধ্যে কয়েকজন কাউন্সিলম্যান দাবি করেন, মেয়র ব্লাজিও তাঁদের স্বাক্ষর স্ক্যান করে আমাজনকে এই শহরে আনার বিল পাস করেন। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, আমাজনের কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, তাদের দায়িত্ব কে নেবে? বাস্তুভিটার সংগ্রামে তাই তাঁরা লং আইল্যান্ড সিটির আশপাশের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে অভিবাসীদের সতর্ক করে বলেন, আমাজন প্রযুক্তি বিক্রি করবে অভিবাসন পুলিশদের কাছে। অনেকটা সাইবার ইনফরমার হিসেবে কাজ করবে তারা অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে।