একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নারী সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন এবং উপজেলা নির্বাচনের চেয়ারম্যান মনোনয়ন-এই তিনটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একটি বার্তা দিয়েছে। তা হলো নতুনের জয়গান। সর্বত্রই নতুনের জয়জয়াকার হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত; এই মনোনয়নগুলোর মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক সূত্রে বারবার বলা হচ্ছে, নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রবীণরা বাদ পড়ছেন। দলের হেভিওয়েটরা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আগেই বাদ পড়েছিলেন, এরপর বাদ পড়লেন মন্ত্রিসভা থেকেও। তারা শুধুমাত্র উপদেষ্টার আলঙ্কারিক পদে বহাল আছেন।
আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে দলীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। উপজেলা নির্বাচন শেষে জেলা পর্যায়ে কাউন্সিলের তোড়জোড় শুরু করবে দলটি। শোকের মাস আগস্টের পর সেপ্টেম্বরে জেলা পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বকে বরণ করে নেয়া হবে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে। এখন থেকেই দলটির মধ্যে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কে হবেন?
যেভাবে আওয়ামী লীগ থেকে পুরনোরা বাদ পড়ছেন, একই ধারায় দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও হয়তো সরে যেতে হতে পারে। অপেক্ষাকৃত তরুণ কাউকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে সেটা কবে হবে তা নিশ্চিত নয়। আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে সাধারণত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুই মেয়াদের জন্য দায়িত্বে থাকেন। যেমন আবদুল জলিল এক মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তারপর তাকে পদ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তবে সৈয়দ আশরাফ দুই মেয়াদেই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেই বিবেচনায় দলের পরবর্তী কাউন্সিলে ওবায়দুল কাদের আবারও দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তিনি যদি আবার সাধারণ সম্পাদক হলেও এসয়ম স্পষ্ট হয়ে যাবে দলের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে কারা থাকবেন বা নতুনদের জন্য দলের সাংগঠনিক কাঠামো কীভাবে সাজানো হবে।
আবার আওয়ামী লীগের অনেক সূত্র বলছে, যেহেতু ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হিসেবে খুবই ব্যস্ত থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন দলকে সংগঠন থেকে আলাদা করতে, সংগঠন যেন শক্তিশালী হয় এবং ব্যস্ততার কারণে যেন সাংগঠনিক তৎপরতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তনও হতে পারে। মন্ত্রী নন এমন একজন, যিনি সার্বক্ষণিকভাবে দলের জন্য কাজ করতে পারবেন এমন কাউকে সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে। দলটির একজন নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ একটি বিরাট সংগঠন। দল পরিচালনা একটি সার্বক্ষণিক কাজ। কাজেই দলের জন্য একজন পূর্ণকালীন নেতৃত্ব ও সাধারণ সম্পাদক প্রয়োজন। সে বিবেচনা থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসা অস্বাভাবিক নয়।
যদি পরিবর্তন আসে তাহলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কে হতে পারেন? দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন চারজন। এদের মধ্যে ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এত বড় দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাছাড়া এই পদের জন্য তৃণমূল থেকে উঠে আসার যে রীতি, তা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মাহবুবুল আলম হানিফ এবারের নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তবে তিনি ছাত্র বা যুব রাজনীতিতে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বা পদে ছিলেন না। এসব বিবেচনায় এ দুজনকে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য বিবেচনায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন আবদুর রহমান এবং জাহাঙ্গীর কবীর নানক। তারা দুজনই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। পরবর্তীতে তারা সরকারী কোন পদ-পদবীও পাননি। সে বিবেচনায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক পদে এদের কেউ আসতে পারেন। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর কবীর নানক ছাত্রলাগ-যুবলীগ করে আসা। কিন্তু যেহেতু তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি, তাই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি এনামুল হক শামীম। শামীম এমপি এবং উপমন্ত্রীও হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। এজন্য অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগ যখন সাধারণ সম্পাদক পদে তরুণ প্রাণের প্রবাহ করবে তখন হয়তো এনামুল হক শামীমদের মতো তরুণদের বরণ করে নেয়া হতে পারে। যদিও সেটা এতো জলদি হওয়ার সম্ভাবনা কম। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এমন কাউকে বাছাই করা হবে যিনি দলের সঙ্গে সংযুক্ত, বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর কাছে পরিচিত। সে বিবেচনা থেকে আগামী কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।
তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সবসময় নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। যেহেতু দলের নতুন সাধারণ সম্পাদক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, নতুন সাধারণ সম্পাদক খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেজন্য ওবায়দুল কাদের শেষ পর্যন্ত নাও থাকতে পারেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবারের নির্বাচনের পর থেকে একের পর এক চমক দেখিয়ে চলেছেন। সেই ধারায় দলের সাধারণ সম্পাদকের পরিবর্তন যদি হয়, সেটাও হবে একটি বড় চমক।