একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। অপরদিকে বিএনপি অভিযোগ করেছে অনেক আসনেই ভোটের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের লোকজন ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেছে। আর ভোটের কথিত ফলাফলকে বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে নির্বাচনের ভোট গ্রহণ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ভারত, নেপাল, সার্ক ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের খবর নিয়ে বিশ্বের প্রায় বড় বড় সব গণমাধ্যম ফলাও করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। খবরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়মের চিত্রও প্রকাশ করা হয়।
বিবিসি:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি অনলাইনের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ নির্বাচন: নতুন করে ভোটের দাবি বিরোধী দলের’। বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন এ নির্বাচনকে ‘প্রহসনের’ নির্বাচন বলে উল্লেখ করে নতুন করে ভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একটি কেন্দ্রে নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই বাক্সে ব্যালট পেপার ফেলা হচ্ছে—এমনটা প্রত্যক্ষ করেছেন বিবিসির প্রতিবেদক।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, নির্বাচন কমিশন বলেছে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনিয়মের বিষয়ে জানতে পেরেছে কমিটি। এই বিষয়ে তদন্ত করা হবে। এ ছাড়া ভোট চলাকালে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ১৭ জন নিহত হয়েছে।
সিএনএন:
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের খবরে ভোট ঘিরে সহিংসতা ও কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে। ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। একটি আসনের নির্বাচন বাকি। বিএনপি পেয়েছে সাত আসন। ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্সে ভোট ভর্তি করে রাখার অভিযোগে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। গতকাল নির্বাচনী সহিংসতায় ১৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামেই নয়জন। দেশজুড়ে সহিংসতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা (৭১)। ২০১৪ সালে বিএনপি ও অন্যান্য দল নির্বাচন বর্জন করায় অধিকাংশ আসন পায় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে দুর্দান্ত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে কর্তৃত্বপরায়ণতা, গণমাধ্যম ও বিরোধীদলের ওপর হয়রানির অভিযোগ উঠে। মানবাধিকার সংস্থা ও প্রতিপক্ষরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতার আশ্বাস সত্ত্বেও রোববারের নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে। লন্ডন ভিত্তিক সাংবাদিক সলিল ত্রিপাটি বলেন, সরকার অ্যানফ্রেলের মতো বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা দিতে দেরি করেছে। স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের সুযোগ নষ্ট করে বাংলাদেশ। যদি পর্যবেক্ষকদের অনুমতি না দেন তবে কিভাবে তা স্বচ্ছ প্রমাণ হবে?
তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনা নির্বাচনে আসবেন তা প্রত্যাশিত ছিল। কারণ বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। বিএনপির সমর্থকেরা দাবি করেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ত্রিপাটি বলেন, হাসিনা না জিতলে সেটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা হতো। প্রতিপক্ষের জন্য নির্বাচনী প্রচার ও ভোট প্রদানে নানা বাধা ছিল।
টাইমস অব ইন্ডিয়া:
‘নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় জয়, বিরোধীদের নির্বাচন বাতিলের দাবি’ শিরোনামে প্রতিবেদন করে। সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন শেখ হাসিনার অবদানের কথা বলা হলেও মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ভিন্নমত দমনের কথা বলা হয়। তবে শেখ হাসিনা বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দলের নেতাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসিনা নতুন করে ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর প্রথম কাজগুলোর একটি হবে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন, যত দ্রুত সম্ভব নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নতুন করে ভোট গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে তারা ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ব্যাপক বিজয়ে আলাদা প্রতিবেদন করে। তাঁর আসনে (নড়াইল ২) প্রাপ্ত ভোটের ৯৬ শতাংশ ভোট তাঁর পক্ষে পড়েছে।
আল জাজিরা:
কাতারভিত্তিক এই গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে জয়ী বলে ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। তবে সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে প্রধান বিরোধী জোট। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২৮৮টি আসনে জয় পেয়েছে। আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ছয়টি আসনে জয়ী হয়েছে।
গতকাল রোববার রাতে তড়িঘড়ি করে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্ট নেতা নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে উল্লেখ করেছেন। দেশটির নিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে গড়া সংবিধানের প্রণেতা ও আইনজ্ঞ ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন (৮২) বলেছেন, ‘আমরা প্রহসনের এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি। নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে আমরা একটি নতুন নির্বাচন চাই।’
১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া শেখ হাসিনা গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও পোশাক শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান। পোশাক শিল্প রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। এ খাতে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। ৭১ বছর বয়সী শেখ হাসিনা রেকর্ড সংখ্যক চতুর্থবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। তবে এই ব্যাপক জয়ে বড় আকারের অনিয়মের চিত্র প্রকাশ হয়েছে। এটাকে জনগণের রায় বলে গণ্য করা যায় না।
দ্য টেলিগ্রাফ, কলকাতা:
২৮৮ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়লাভ করলেও বিরোধীরা ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে মহাজোটের সমর্থকদের বাধার মুখে লোকজন ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেনি বলে অভিযোগ করা হয়। সরকার গঠনের জন্য ১৫১ আসন প্রয়োজন হলেও প্রধান বিরোধী জোটের নেতা এই নির্বাচনকে প্রহসন উল্লেখ করে তা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। অনেক পোলিং এজেন্ট জানিয়েছে তারা ভয়ে কেন্দ্র থেকে দূরে ছিলেন। আবার অনেকে অভিযোগ করেন তাদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে সিরাজগঞ্জের প্রার্থী রুমানা মাহমুদ টেলিগ্রাফের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর ৯০ ভাগ সমর্থককে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পার্টির নেতা কর্মীরা বাধা দিয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ব্যালটে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভরাট করেছে। এই আসনের এক নারী ভোটার দাবি করেন, পুলিশ তাদের স্বাধীনভাবে ভোট দিতে দেয়নি। পুলিশ বলেছে যদি নৌকায় ভোট দেয় তাহলেই কেবল ভোট দিতে পারবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার ক্ষমতা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি এক দলীয় শাসনে পরিণত হতে চলেছে।