চলচ্চিত্র আর নাটকে অভিনয় দিয়েই জনপ্রিয়তা পান তাঁরা। তাঁদের মধ্যে কেউ আবার অভিনয় দিয়ে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, মানুষের মনও জয় করেছেন। শোবিজ জগতের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তারকাদের মধ্য থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কয়েকজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, চেষ্টা-তদবির করেও নৌকায় ঠাঁই হয়নি অনেক তারকার। আবার তাঁদের মধ্য থেকে কেউ দেখিয়েছেন চমক।
সারাহ বেগম কবরী অভিনয় থেকে সরাসরি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিলেন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। ‘চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে’খ্যাত অভিনেত্রী ও রাজনীতিবিদ সারাহ বেগম কবরী এবারও দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। তবে এবার নারায়ণগঞ্জ-৪ নয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ থেকে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু বরেণ্য এ অভিনেত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন চলচ্চিত্রে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী আরেক বরেণ্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক)। ফারুক অবশ্য মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ) থেকে।
বর্তমান সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম টাঙ্গাইল-৬ (দেলদুয়ার-নাগরপুর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যুবলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন তারানা হালিম। পরে পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে একই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ আসন থেকে তারানা ছাড়া আরও ১২ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। শেষ পর্যন্ত দল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটুর প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়।
অভিনয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে রাজপথে সোচ্চার দেখা গেছে রোকেয়া প্রাচীকে। ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। এবার সরাসরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিন বছর ধরে ফেনী-৩ আসনের আনাচকানাচে মানুষের সঙ্গে নানা ইস্যুতে কথা বলেছেন, জনসংযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী রোকেয়া প্রাচী এবার ফেনী-৩ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। কিন্তু এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এখনো পর্যন্ত কাউকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
শোনা যাচ্ছে, এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় আলোচিত এই সেনা কর্মকর্তা এখন অবসরে আছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের সুলাখালী গ্রামে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-৩ আসন (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম নিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন ফরম নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। পরদিন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন এক-এগারোর সময় আলোচিত সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
আজ সোমবার সকালে রোকেয়া প্রাচী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো দলের পদ আছে। কাজ করে যাব। কাজ থামবে না। নৌকার জন্য, আপার (শেখ হাসিনা) জন্য, এলাকার তরুণ প্রজন্ম আর নারীদের জন্য কাজ করে যব। রাজনীতিবিদের তো কাজ থেমে থাকার না। আমার কাছে নৌকার বিজয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী করতে হবে।’
ফেনী-৩ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী শমী কায়সার। মনোনয়ন ফরম নেওয়ার আগে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। এ আসনকে নৌকার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং বলেও প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেছিলেন, নিজের এমপি হওয়ার চেয়ে এলাকার উন্নয়নে, নৌকার জয়ের জন্য কাজ করাটাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। মনোনয়ন পেলাম, এমপি হলাম, নাকি মন্ত্রী হলাম—এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।
মনোনয়ন দৌড়ে এবার দেখা গেছে অভিনয়শিল্পী তারিনকেও। তিনি ঢাকা-১০ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার পর তারিন জানিয়েছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন, তাহলে আমি সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেব। যদি মনোনয়ন না পাই, যিনি পাবেন, তাঁর জন্য কাজ করব। আসলে আমি দলের জন্য কাজ করব।’ তারিন জানান, যেদিন থেকে রাজনীতি বোঝেন, সেদিন থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন ২০১৩ সালে।
অভিনয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয় জ্যোতিকা জ্যোতি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসন থেকে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তিনি। তাঁর মতে, পরিবার, এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চাওয়ায় রাজনীতিতে আসেন তিনি। তিনি বলেন, ‘যদি দল মনে করে প্রার্থী করবে, তবে আমি মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাব। আর যদি না–ও মনে করে, এরপরও আমার এলাকার জন্য কাজ করে যাব।’ এ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সাংসদ নাজিউদ্দিন আহমেদ। মনোনয়ন না পাওয়ায় আফসোস নেই জ্যোতির। দলের হয়ে নৌকার জয়ের জন্য কাজ করবেন বলে জানান তিনি। আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকার জয়ের জন্য প্রচার–প্রচারণা করব। নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকতে হবে। অভিনয়ও চলবে। আমি মনে করি, ইচ্ছা আর ভালোবাসা থাকলে অভিনয় ও রাজনীতি দুটিই একসঙ্গে সম্ভব। আমি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, একসঙ্গে অনেক অনেক কাজ করা সম্ভব। এলাকার মানুষ অপেক্ষা করছে, তাদের কাছে যাব। তাদের নিয়ে নৌকার বিজয়ের জন্য কাজ করব। আমার আসনে যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খল অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের হয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৪ (মিরপুর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তিনি। ডিপজল তখন বলেন, ‘এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করে এ আসনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ আসলামুল হককে এবারও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
কৌতুক অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পান টাঙ্গাইলের সিদ্দিকুর রহমান (ভক্তদের কাছে তিনি সিদ্দিক নামে পরিচিত)। তাঁর মতে, অভিনয়ের পাশাপাশি ২০০৮ সাল থেকে নিজ এলাকায় গণসংযোগ করছেন। এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। নিজের হাতে অনেকগুলো সংগঠন করেছেন এলাকায়। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। মধুপুর-ধনবাড়ী এ দুটি উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-১ আসন। এ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি পরপর তিনবার এ আসনের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবারও তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে লড়ার টিকিট দেওয়া হয়েছে।
‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটি পরিচালনা করে আলোচনায় আসেন মাসুদ পথিক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নির্মাতা। নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান তিনি। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার পর তিনি বলেন, ‘এটা আকস্মিক কিছু নয়। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরেই আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাকে মনোনয়ন দেন, তা হলে নির্বাচন করব।’ নরসিংদীর এ আসনে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুকে।
চমক দেখালেন ফারুক
তারকাদের মধ্যে এবার সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছেন চলচ্চিত্রের ‘মিয়াভাই’খ্যাত বরেণ্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক)। দর্শক তাঁকে ফারুক নামেই চেনেন। আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ফারুক তাঁর জন্মস্থান গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ) আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। মনোনয়নপত্র চূড়ান্ত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকে চাউর হতে থাকে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী থেকে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন তিনি। এ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও লড়ার সম্ভাবনার কথা শোনা যায়। এ আসন থেকে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৪ সালে নির্বাচনে এ আসনে সাংসদ হন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের এস এম আবুল কালাম আজাদ। ঢাকা-১৭ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার মধ্য দিয়ে কালীগঞ্জের ছেলে ফারুক ঢাকা-১৭ (গুলশান-বনানী-ঢাকা সেনানিবাস-ভাষানটেকের কিছু অংশ) এলাকায় আওয়ামী লীগের হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়বেন।
নিজ এলাকায় আবার আসাদুজ্জামান নূর ও মমতাজ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়বেন আসাদুজ্জামান নূর ও মমতাজ বেগম। আসাদুজ্জামান নূর নীলফামারী-২ আসন থেকে ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন। এবারও তিনি এ আসন থেকে লড়ছেন। ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংসদ মনোনীত হন মমতাজ। ২০১৪ সালে এ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।